তথ্যপ্রযুক্তি

স্মার্টফোনে সময় না কাটিয়ে সন্তানকে সময় দিন

বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে অসংখ্য শিশু স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় কাটাচ্ছে। এতে শুধু তাদের চোখের ক্ষতিই নয়, সামগ্রিক বিকাশও ব্যাহত হয়। শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহারে বাবা-মা কতটুকু দায়ী? আমাদের দেশে অনেক মা-বাবাই শিশুদেরকে স্মার্টফোন দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়ান। এই সময়টা শিশুরা একমনে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। মা-বাবা ও সন্তানেরা একসঙ্গে থাকার সময়ও প্রত্যেকেই নিজের স্মার্টফোনে ব্যস্ত—এ দৃশ্য এখন সাধারণ হয়ে গেছে। পাশাপাশি থেকেও পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ব্যাপারটি শিশুদের বেড়ে উঠার জন্য উদ্বেগজনক।

২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ প্যানেল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য স্ক্রিনে কাটানো সময়, বসে থাকা কমানোসহ পর্যাপ্ত ঘুম এবং সক্রিয় খেলায় বেশি সময় দেওয়া-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে। এক বছর বয়স পর্যন্ত স্ক্রিন টাইফের (টেলিভিশন, ভিডিও বা ইন্টারনেটে কিছু দেখা) কোনো প্রয়োজন নেই। দুই থেকে চার বছর বয়সীরা দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা স্ক্রিনে সময় কাটাতে পারে, তবে কম হলে ভালো হয়। সব বয়সী শিশুদের পর্যাপ্ত ঘুম এবং খেলাধুলা প্রয়োজন।

নিষ্ক্রিয় জীবনযাত্রার দরুন প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বয়সের অর্ধকোটি মানুষের মৃত্যু হয়। বর্তমানে ২৩ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ও ৮০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় নয়। স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটানো এর বড় একটা কারণ।

বাংলাদেশে অনেক মা-বাবা সন্তানের স্মার্টফোন-আসক্তি নিয়ে অভিযোগ করেন। প্রশ্ন আসে, এ দায় কার? শিশুরা কী খাবে, কোন স্কুলে পড়বে, কোন খেলনা দিয়ে খেলবে, অবসর সময় কীভাবে কাটাবে প্রভৃতি সব সিদ্ধান্ত মা-বাবা নেন। একটা বয়সে সন্তানকে স্মার্টফোন ব্যবহারের অনুমতি দিলেও মা-বাবার দায়িত্ব এর ব্যবহারের জন্য সঠিক নির্দেশনা দেওয়া।

কিছু পশ্চিমা দেশে শিশুদের স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কমানোর উদ্যোগ বেশ আগেই নেওয়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, এর জন্য বড়দের ফোনের আসক্তি কমাতে হবে। বেশ কিছু স্থানে স্কুলে ভর্তির পর শিক্ষকেরা বুঝতে পারছেন, অনেক শিশুর বয়স অনুযায়ী যোগাযোগের দক্ষতা নেই। কেউ কেউ কথা বলতেও শেখেনি। স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ার ফলে সন্তানের প্রতি মা-বাবার মনোযোগ কমে। তাঁরা শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প বলা, কথা বলায় সময় দিচ্ছেন না। শিশুরা পর্যাপ্ত উদ্দীপনা পাচ্ছে না। এর ফলে শিশুর আবেগময় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বাধা এলে সন্তানকে অহেতুক বকাঝকা করার প্রবণতাও দেখা যায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে ফাটল ধরায়।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেনি রাডেস্কি এবং উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মেগান মরেনো জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন পেডিয়াট্রিকস-এ (২০১৮) প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে তুলে ধরেন, শিশুরা মা-বাবার কাছ থেকে স্মার্টফোনের ব্যবহার শেখে। তাই মা-বাবার উচিত স্মার্টফোনের পরিমিত ব্যবহার করা এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সময় কাটানোকে গুরুত্ব দেওয়া। দিনের কিছুটা সময় কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছাড়া থাকা দরকার। পরিবারের সবাই মিলে খাওয়া এবং গল্প করার সময় স্মার্টফোন ব্যবহার না করাই ভালো।

প্রযুক্তি ভালো বা খারাপ নয়। আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি, তার ওপর নির্ভর করে এটি আমাদের জীবনের জন্য কল্যাণকর হবে কি না। স্মার্টফোন দিয়ে যদি কোনো কাজ দ্রুত করা যায় বা এর মাধ্যমে যদি সন্তানদের সঙ্গে একত্রে কোনো কিছু উপভোগ করা হয়, তাহলে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মা-বাবা কি শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে কাটানো ও নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনের নেতিবাচক পরিণতি নিয়ে সচেতন? মা-বাবার কয়েকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন

১. শিশুরা বড়দের দেখেই শেখে। মা-বাবা ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, টেলিভিশনে কম সময় দিলে শিশুরাও এতে কম সময় দেবে।

২. শিশুদের সঙ্গে খেলা, বই পড়ে শোনানো, গল্প করাসহ নানাভাবেই আনন্দের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। মা-বাবা যখন শিশুদের সময় দেবেন, তখন যেন তারা সম্পূর্ণ মনোযোগ পায়। ফোনে চোখ রেখে শিশুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা একধরনের অবহেলা; যা তাদের বিকাশে সহায়ক নয়।

৩. একবার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে সেটা পরিবর্তন করা কঠিন। শুরু থেকেই শিশুদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পরিমিত ব্যবহার শেখাতে হবে।

৪. নিষ্ক্রিয় স্ক্রিন টাইম শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অল্পবয়সী শিশুদের স্ক্রিনে কিছু দেখানোর সময় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে; তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এটি তাদের শেখায় ভূমিকা রাখবে।

৫. শিশুদের বই পড়া, খেলাধুলা, ছবি আঁকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে, যাতে তারা নিজের মতো করে সময় কাটাতে পারে এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল না হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শৈশবকালীন স্থূলতা ও শারীরিক সক্রিয়তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. জনা উইলামসেন বলেন, ‘শিশুদের জীবনে খেলাধুলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিতের পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় সময়কে খেলাধুলার সময়ে রূপান্তরিত করতে হবে।’ আমাদের দেশের খেলার মাঠ দখল করে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থবির। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চাপে শিশুরা দিশেহারা। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আবশ্যক। মা-বাবাকে নিজের ও সন্তানের স্ক্রিনে কাটানো সময় নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুদের খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত এবং সে লক্ষ্যে যথেষ্ট বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। শিশুরা যাতে আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে, তার জন্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

শিশুদের স্মার্টফোন-আসক্তির ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতন হওয়া এবং এর প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আর দেরি নয়।

লেখকঃ লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী (প্রথম আলো)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − 9 =

Back to top button