ধর্ম ও জীবন

যেভাবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন রাসূল সাঃ

সুদীর্ঘ সময় রাসূলুল্লাহ সা: সীমাহীন জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করে প্রবল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মক্কায় ইসলাম প্রচার করছিলেন। অবশেষে কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নবী সা: আল্লাহ তায়ালার আদেশে মদিনায় হিজরত করেন।

মদিনায় এসে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে মনোনিবেশ করেন। ইসলামী সমাজ গঠন ও নিশ্চিন্ত মনে মহান আল্লাহর ইবাদত করতে প্রাথমিকভাবে যেসব কাজ প্রয়োজন, সব প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বদা আল্লাহ ও দ্বীনের জন্য কর্মব্যস্ত সময় ব্যয় করেন। পরিবার, সঙ্গী-সাথী ও মদিনাবাসীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। নবুয়তের ধারক হিসেবে তিনি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, ধর্মপ্রচারক ও মুজাহিদরূপে প্রধান দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে প্রাথমিক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠাঃ এই কাজটি একদিনে সম্ভব হওয়ার কাজ নয়। এ জন্য নবী সা: এটিকে মৌলিক কাজ গণ্য করে সহায়ক কার্যাবলির ওপর গুরুত্ব দিতেন। ইসলাম মূলত দ্বীন ও রাজত্ব তথা আকিদা ও শরিয়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নবী করিম সা: মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জোর দেন। নিজেই রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। মদিনায় শরিয়তের বিধান বাস্তবায়ন শুরু করেন। জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণ সাধনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও রাষ্ট্রের সাথে মদিনাবাসীর সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে দিলেন। ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজনীয় সব বিষয় পুনর্গঠনে জোর দিলেন। যেমন মসজিদ নির্মাণ। আনসার-মুহাজিরদের মাঝে মৈত্রীবন্ধন। মদিনায় বসবাসরত অন্যান্য গোত্রের সাথে চুক্তি সম্পাদন। ইসলামী অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থা প্রণয়ন। মুজাহিদ বাহিনী গঠন। শরয়ী বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

মদিনায় পৌঁছে নবী সা: সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। বহনকারী উট বসার স্থানকে তিনি মসজিদের জন্য নির্বাচন করেন। জমিটি ছিল বনি নাজ্জারের দু’জন এতিম বালকের। প্রস্তাবের পর তারা স্বেচ্ছায় দান করতে চাইলেও নবী সা: তাদের থেকে জমি ক্রয় করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের সাথেই নবী সা:-এর পরিবারের জন্য হুজরা নির্মাণ করা হয়। এরপর সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নামাজ, শিক্ষা, জিহাদ, সামাজিক কার্যক্রমসহ অন্যান্য ইবাদত পালন করতে থাকেন।

ইসলাম প্রচারঃ আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে প্রাপ্ত রিসালাতের শিক্ষা কোনো প্রকার কমবেশি না করে নবী সা: মানবজাতির কাছে প্রচার করেছেন। মিথ্যা বলা ও ইলম গোপন করার অপরাধ থেকে আল্লাহ তায়ালা নবী সা:কে পরিপূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন। উম্মতের প্রতিটি সন্তান এ কথার সাক্ষী। পবিত্র কুরআন নবী সা:-এর পরিচয়ের পূর্ণ চিত্র বর্ণনা করেছে। নবী সা: কোনো উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন না। তিনি গায়েবের খবরও জানেন না। তিনি হলেন সুসংবাদদানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী। ওহির সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছানোর দূত। মানুষদেরকে ঈমানদার করতে ইসলামের মূল ভিত্তি বিষয়গুলো তিনি জোরেশোরে প্রচার করেন মদিনায়।

আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের বিষয়টি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল উদাহরণ। নবী সা: মক্কা থেকে আগত ঘরবাড়ি ও পরিজনহারা সাহাবায়ে কেরামের সাথে মদিনার স্থায়ী বাসিন্দা আনসার সাহাবাদের সর্ববিষয়ে ‘ভাই ভাই’ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ফসলের জমি, ফলের বাগান এমনকি ব্যবসা লাভের মধ্যেও মুহাজির-আনসারদের পরস্পর উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেন। শুরু হয় সবার সম্মিলনে ইসলামের নবযাত্রা।

ইসলামী বাজার অর্থব্যবস্থা চালুঃ মদিনায় পৌঁছে নবী সা: দেখলেন সব বাজারে ইহুদিরা নিজস্ব কর্তৃত্ব ও রীতিতে ক্রয়-বিক্রয় ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইহুদিরা সুদ, গুদামজাত, কৃত্রিম পণ্যস্বল্পতা ইত্যাদি সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করছে চরমভাবে। নবী সা: মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর একটি ইসলামী বিশেষ বাজার স্থাপন করলেন। ফলে সাধারণ মানুষ ইহুদিদের বাজার পরিত্যাগ করে মুসলমানদের বাজারে কেনাকাটা শুরু করল। অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য মুহাজির ও আনসারদের ভেতর মদিনার ভূমি বণ্টনের পলিসি গ্রহণ করলেন। বললেন, ‘যে ব্যক্তি পড়ে থাকা জমি আবাদ করবে, সে জমি তার।’ এ ছাড়া মুজারায়া, মুশারাকা, মুদারাবা ইত্যাদিসহ ব্যবসার বিভিন্ন পদ্ধতি শিক্ষা দিলেন। অল্প সময়েই মদিনার অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠল। এভাবেই নবী সা: মদিনায় ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ইসলামী সেনাবাহিনী গঠন : ইসলামী রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও শত্রুদের প্রতিহত করতে মুসলমানদের সৈন্যবাহিনী প্রতিষ্ঠায় নবী সা: সীমাহীন গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কেননা, আল্লাহ তায়ালা শত্রুদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তোমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকো, যাবৎ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে যায়’। ফলে মুসলিম সৈন্যদের প্রশিক্ষণ, প্রস্তুত, যুদ্ধাস্ত্র তৈরির প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কৌশল শিখতে নবী সা: সাহাবাদের একটি জামাতকে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন।

সাহাবায়ে কেরামের পরিচর্যাঃ নবী সা: আল্লাহ প্রদত্ত নিজের ভিশন বাস্তবায়নের জন্য সাহাবাদের প্রজন্মকে একটি সোনার সঙ্ঘরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বোত্তম শিক্ষা-দীক্ষায় প্রশিক্ষিত করেছেন। সাহাবাদের প্রত্যেকের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটেছে। আল্লাহ তায়ালা নিজের দ্বীনের সাহায্য, বিজয় ও প্রচারের জন্য সাহাবাদের সোনালি এই প্রজন্মকেই নির্বাচন করেছিলেন। ইসলামের বিজয়ের লক্ষ্যে নবী সা: সাহাবাদেরকে তৎকালীন ইসলামবিরোধী শত্রুদের সংস্কৃতি, ভাষা ও রীতি শিক্ষার আদেশ দেন। সমগ্র বিশে^ ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন করার লক্ষ্যে শিক্ষা, আখলাক, মানবসেবা, বীরত্ব ইত্যাদি যত গুণাবলি প্রয়োজন, নবী সা: তাদেরকে সব শিক্ষা দিয়েছিলেন। পৃথিবী এক সময় তার পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখেছে।

ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থাঃ ইসলামের বাণী ফলপ্রসূ ও গ্রহণযোগ্য করতে নবী সা: সবাইকে এক বিচারব্যবস্থার অধীনে আনতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বর্ণ, গোত্র, পরিচয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সবাইকে ভালোবাসাপূর্ণ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে এক কাতারে দাঁড় করেছিলেন। পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক যেকোনো বিষয়ে ন্যায়বিচার বাস্তবায়ন করেছিলেন কঠোরভাবে। সামাজিক ও ধনী-গরিবের বৈষম্য বিলুপ্ত করেছিলেন। কুরআন ও সুন্নাহকে নির্ধারণ করেছিলেন সব সমস্যার সমাধানকারীরূপে। বিচারের ক্ষেত্রে আমির-ফকিরের কোনো তারতম্য নবী সা:-এর বিচারব্যবস্থায় ছিল না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × two =

Back to top button