একনজরে মামুনুল হক
আল্লামা মামুনুল হক একজন বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, ইসলামি বক্তা, লেখক, অধ্যাপক ও সমাজ সংস্কারক।
তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকার শায়খুল হাদিস, বাবরি মসজিদ বাংলাদেশ, মাহাদুত তারবিয়্যাতুল ইসলামিয়া ও তারবিয়্যাতুল উম্মাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, মাসিক রহমানী পয়গামের সম্পাদক, বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের সভাপতি ও বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব।
তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ইসলামি বক্তাদের সংগঠন রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন বাংলাদেশের উপদেষ্টাসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পদে রয়েছেন।
ইংরেজি সহ পাঁচটি ভাষায় তার দক্ষতা রয়েছে। ইসলামি নেতা হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিত। নাস্তিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়ে তিনি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
ইসলামি মৌলবাদ প্রচারের অভিযোগে তাকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ ৬৫টি সংগঠন দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন করেছে। তাকে অভিযুক্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহি মামলা সহ অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ অসংখ্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন।
জন্ম ও বংশ
মামুনুল হক ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে আজিমপুর, ঢাকার একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আজিজুল হক ছিলেন একজন বাংলাদেশি ইসলামি পণ্ডিত ও সহিহ বুখারীর প্রথম বাংলা অনুবাদক, যিনি ‘শায়খুল হাদিস’ নামে সমাধিক পরিচিত। তার ভাইবোনের সংখ্যা ১৩ জন। মাহফুজুল হক তার অগ্রজ, একজন প্রভাবশালী ইসলামি পণ্ডিত ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব।
শিক্ষাজীবন
প্রাথমিক জীবনে মামুনুল হক তার পিতা আজিজুল হকের নিকট লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে ১২ বছর বয়সে তিনি লালবাগ চানতারা জামে মসজিদ মাদ্রাসায় কুরআনের হেফজ (মুখস্থ) সমাপ্ত করেন। ১৯৮৬ সালে ভর্তি হন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকায়।
১৯৯৩ সালে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকা থেকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধীনে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে প্রথম স্থান, ১৯৯৫ সালে স্নাতক শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান এবং ১৯৯৬ সালে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। পাশাপাশি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সমাপ্ত করেন।
কর্মজীবন
তিনি পাঁচ বছর সিরাজগঞ্জ জামিয়া নিজামিয়া বেথুয়া মাদ্রাসা এবং দুই বছর মিরপুর জামিউল উলুমে শিক্ষকতা করেন। তারপর ২০০০ সাল থেকে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকার শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
২০১৫ সালে তিনি মাহাদুত তারবিয়্যাতুল ইসলামিয়া নামে একটি উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন।
এছাড়াও তিনি পুরান ঢাকার বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব।
২০২০ সালের ১০ অক্টোবরে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও ১৫ নভেম্বর হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২৬ ডিসেম্বর হেফাজতের এক সভায় তাকে ঢাকা মহানগরীর মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশের ইসলামি বক্তাদের সংগঠন রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন বাংলাদেশের উপদেষ্টা নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে তিনি ঢাকায় বাবরি মসজিদ বাংলাদেশের নির্মাণ কাজ শুরু করেন।
পরিবার
পারিবারিক জীবনে তিনি বিবাহিত ও তিন ছেলের জনক। তার স্ত্রী কুরআনের হাফেজ এবং শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও তাবলিগ জামাতের সদস্য।
গ্রেফতার
২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজত আন্দোলনে নেতৃত্বের জন্য ১২ মে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এসময় তিনি ‘কারাগার থেকে বলছি’ নামক একটি বই রচনা করেন, যা ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।
দৃষ্টিভঙ্গি
ভাস্কর্য ও মূর্তি
তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে ভাস্কর্য ও মূর্তিকে এক হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং এগুলো নির্মাণ করার অনুমতি ইসলামে নেই বলে মন্তব্য করেন। আইনগতভাবে, নৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সামর্থ্য থাকলে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যসহ সব ভাস্কর্যই মুসলমানদের জনপদ থেকে অপসারণ করার উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। প্রাণীর অবয়ব অঙ্কন কারীদের তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেন এবং এ বিষয়ে কুরআন-হাদিসের দলীল প্রদান করেন।
জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামী দুটি বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং ভুল থেকে বেরিয়ে আসলে তাদের সাথে যেকোনো দল ঐক্য করতে পারবে বলে তিনি মত দেন। বিষয় দুটির ব্যাপারে তিনি বলেন, একটি হল জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদীর বিভিন্ন বক্তব্য ইসলামের মূলভিত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অন্যটি একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা।
১৯৭২’র সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি কোনদিন ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশের সব ভাস্কর্য অপসারণ ও ইসলামের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।[১৭]
উপাধি
২০২১ সালের ৮ মার্চ লাখো মানুষের উপস্থিতিতে আয়োজিত ইসলামি মহাসম্মেলনে চুয়াডাঙ্গা জেলা উলামা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে বাংলার বাঘ তথা ‘বঙ্গবাঘ’ উপাধি দেয়া হয়। ‘বঙ্গবাঘ’ উপাধি দিয়ে তা মাইকে ঘোষণা করা হলে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন শহর, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা থেকে আগত লাখ লাখ মানুষ নারায়ে তাকবির – আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মাহফিলস্থল প্রকম্পিত করে তোলে।[১৮]
প্রকাশনা
তার সম্পাদিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ১৪ টি। ২০০১ সাল থেকে তিনি মাসিক রহমানী পয়গামের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। এছাড়াও সমসাময়িক বিষয়াবলিতে তিনি জাতীয় ও দৈনিক পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে থাকেন।
বইসমূহ
- কারাগার থেকে বলছি (২০১৩)
- মেহরাব ও মিম্বারের কথা
- সময়ের পয়গাম
- স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের ভূমিকা
- সত্যের পথে সংগ্রাম
- নারী অধিকার : ব্যাখ্যা ও ভ্রান্তি নিরসন
- পহেলা বৈশাখ : ইসলাম কি বলে?
- সফল মুমিনের পরিচয়
- একটি দ্বীনি দাওয়াত
- খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা : পরিচিতি ও নীতিমালা
- ইসলামি আন্দোলনে চাই জিন্দাদিল কর্মী
- ইসলামি সংগঠনে নেতৃত্ব ও আনুগত্য
- নেতৃত্ব, আনুগত্য ও ইসলামি জীবন
- ইসলামি সংগঠন কি এবং কেন?
সমালোচনা
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে “আপত্তিকর বক্তা” হিসেবে চিহ্নিত করে।[২১] ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি ঢাকায় একটি সম্মেলন করে ভাস্কর্য ও মূর্তি নির্মাণকে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড হিসেবে হিসেবে উপস্থাপন করেন, শেখ মুজিবুর রহমানসহ কারো ভাস্কর্য নির্মাণ করা যাবে না, বলে মন্তব্য করেন এবং এই মূর্তি সংস্কৃতিকে রুখে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে আবার শাপলা চত্বরে যাওয়ার হুমকি দেন।
তার এই মন্তব্যে আওয়ামী লীগসহ ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসমূহের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৫ নভেম্বর শ্যামা পূজা উপলক্ষে চট্টগ্রামের গোল পাহাড় কালী মন্দিরে আয়োজিত আলোচনা সভায় মামুনুল হককে ইঙ্গিত করে শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, “সাবধান হন, না হলে ঘাড় মটকাতে সময় লাগবে না।”
১৬ নভেম্বর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন কর্তৃক ৭২ ঘন্টার মধ্যে তাকে গ্রেফতারের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। গ্রেফতার না হওয়ায় এই সংগঠনটি ২১ নভেম্বর আরেকটি প্রতিবাদ সমাবেশ করে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং মামুনুল হককে গ্রেফতারসহ সরকারকে ৭ দফা দাবি জানায়।
২৬ নভেম্বর ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে তাকে জঙ্গিবাদী আখ্যায়িত করেন এবং লেজ কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
একই দিন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগ চট্টগ্রামে একটি সমাবেশ করে চট্টগ্রাম জেলায় যেকোন মূল্যে মামুনুল হককে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন এবং তার একটি কুশপুত্তলিকা দাহ করেন।
পরদিন, ২৭ নভেম্বর, হাটহাজারীতে মামুনুল হকের সমাবেশ ছিল। সেদিন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলো চট্টগ্রামের বিমানবন্দর ও শহরের প্রবেশপথগুলো ঘেরাও করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মীরা কয়েক ঘণ্টার জন্য রাস্তা অবরোধ করে রাখেন এবং মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে দেন।
মামুনুল হক বাধা উপেক্ষা করেই হাটহাজারীতে আসেন। পরবর্তীতে বিশৃঙ্খলা এড়াতে প্রশাসনের অনুরোধে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।
বাধাদানে ক্ষুব্ধ হয়ে মামুনুল হকের কয়েক হাজার সমর্থক ফেসবুকে গ্রুপ খুলে এবং ঢাকার বায়তুল মোকাররমে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে উভয় পক্ষের সংঘর্ষ হয়, বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
২৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনটি মামুনুল হককে ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতারের দাবিতে ১ ঘণ্টার জন্য শাহবাগ অবরোধ করে রাখে।
৩০ নভেম্বর ফরিদপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী তাকে “খেলা হবে” বলে চ্যালেঞ্জ করেন এবং সাহস থাকলে যুবলীগের সঙ্গে মাঠে নামতে বলেন।
১ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে দেশের প্রায় ৬৫টি সংগঠন মামুনুল হককে গ্রেফতারের দাবি করে। এই সমাবেশে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক ভাস্কর্য ইস্যুতে মামুনুল হকের বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে “পরিণতি ভাল হবে না” বলে মন্তব্য করেন।
৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের আপত্তিতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় তার সমাবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, নড়াইলসহ কয়েকটি জায়গাতেও তার সমাবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৪ ডিসেম্বর তার সমর্থনে পল্টনে ভাস্কর্যবিরোধী মিছিলের চেষ্টা করা হলে পুলিশের লাঠিচার্জে তা পণ্ড হয়ে যায়।
৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ মামুনুল হকের নামে “রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা” করার ঘোষণা দেয়।[৩৯] সেই রাতে কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের একটি নির্মাণাধীন ভাস্কর্যে ভাঙচুর করা হয়। পরবর্তীতে অভিযুক্তরা মামুনুল হকের বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে এই কাজ করেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে।
৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা করা হয়। আদালত ৭ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত করে পিবিআইকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে মামুনুল হক বলেন, “তিনি তার কথা বলেই যাবেন।”
৯ ডিসেম্বর ভাস্কর্যবিরোধী ষড়যন্ত্র ও মামুনুল হকের বক্তব্যে সহযোগিতার অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ মোট ৬ জনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করা হলে, তা আদালতে খারিজ হয়ে যায়।[৪২][৪৩] ১০ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে” মামলার আবেদন করা হয়।আদালত এই আবেদন আমলে না নিয়ে আবেদনকারীদের থানায় যাওয়ার আদেশ দেয়।
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জামায়াত ঘনিষ্ঠতার নানা অভিযোগ আনা হয়; কিন্তু তিনি এগুলো অস্বীকার করেন ও অভিযোগ “ভিত্তিহীন” বলে আখ্যায়িত করেন।
২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর ফরিদপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী এক বক্তব্যে মামুনুল হককে জঙ্গি আখ্যায়িত করে বলেন, “এ মঞ্চে এসে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। প্রশাসনের লোক আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। আমরা কি ভীতু যে আমাদের প্রশাসনের লোক নিরাপত্তা দেবে? আমাদেরকে পাহারা দিতে হবে না। যদি পাহারা দিতে হয় জঙ্গি মামুনুল হকদের দেন। কারণ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম প্রস্তুত হচ্ছে আরেকটি যুদ্ধের জন্য।”
একইদিন বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামিক পার্টির সভাপতি ইসমাইল হোসাইন এক মানববন্ধনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় মামুনুল হককে অভিযুক্ত করে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলাম ও আলেম সমাজের জন্য যা কিছু করেছেন, অন্য কোনো সরকার তা করে নাই। মাদ্রাসাছাত্রদের দিয়ে ভাস্কর্য ভাঙচুর করে সারাদেশের সব মাদ্রাসাছাত্রকে অপমান করছে মামুনুল হকরা।”
ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় তার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হলে, তিনি এই ঘটনাকে অনভিপ্রেত আখ্যায়িত করে বলেন, আমি কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বলি নি।
১৭ ডিসেম্বর কুমিল্লায় একটি মাহফিলে গোপনে যোগদান করে বক্তব্য রাখার অভিযোগে মামুনুল হক ও খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবীসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ।
২ ফেব্রুয়ারি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় তার একটি মাহফিলে যোগদানে প্রশাসন কর্তৃক বাঁধা দেওয়া হয়। এ খবরে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় উত্তেজিত জনতা শহরের কাউতলী ও ভাদুঘর এলাকায় মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ করে লাঠিসোঁটা নিয়ে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থান নেয়। বিক্ষুব্ধরা মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এতে মধ্যরাতে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে তিনি অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী ইউনিয়নের ময়েনদিয়া গ্রামের এক যুবক মামুনুল হককে নিয়ে একটি পোস্টে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এ মন্তব্যের কারণে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে যুবককে লাঞ্ছিত করে এবং জুতার মালা পরিয়ে রাস্তায় ঘুরিয়ে ময়েনদিয়া বাজারে একটি ঘরে আটকে রাখে। জুতার মালা পরিহিত ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। এই ঘটনায় ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।[৫৩]
শাল্লায় হিন্দু পল্লীতে হামলা
মূল নিবন্ধ: ২০২১ বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী সহিংসতা
এক হিন্দু যুবক তাকে কটূক্তির অভিযোগে ১৭ মার্চ ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামবাসী উত্তেজিত হয়ে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের হবিবপুর নোয়াগাঁও গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ৮৮টি বাড়িঘর এবং ৭/৮টি পারিবারিক মন্দির ভাংচুর চালায়। এই ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে শামছুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শাহরিয়ার কবির সহ অনেকেই তাকে গ্রেফতারের দাবি জানায়। কিন্তু এখানো এই ঘটনায় তার এবং তার সংগঠনের কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় নি।[৫৪][৫৫]
বিলাসবহুল গাড়ি বিতর্ক
২০২১ সালের ৬ মার্চ তাকে বিতর্কিত করতে বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন ডিবিসি নিউজ সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিসহ একটি সংবাদ ভাইরাল করা হয়, যাতে দেখা যায় মামুনুল হককে বহনে দেড় কোটি টাকা মূল্যের একটি ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়ী ব্যবহৃত হচ্ছে। তার এত সম্পদের উৎস জানতে চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা হলেও পরবর্তীতে সংবাদটি অপপ্রচার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
সোনারগাঁ রিসোর্টে অবরুদ্ধ
২০২১ সালের ৩ এপ্রিল মামুনুল হক সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে একজন নারীসহ অবকাশযাপন করছিলেন। এ খবর পেয়ে স্থানীয় কিছু লোকজন এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করে রেখে লাঞ্ছিত করে ও পরে প্রশাসনকে খবর দেয়া হয়।
মামুনুল উক্ত নারীর নাম আমিনা তৈয়ব উল্লেখ করে তাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবী করেন।তবে উক্ত নারী জিজ্ঞাসাবাদে নিজের নাম জান্নাত আরা বলে পরিচয় দেন।
মামুনুলকে রিসোর্টে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ছড়িয়ে পরলে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে হেফাজতের কর্মীরা সেখানে জড়ো হয়ে ওই রিসোর্টে ভাঙচুর চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে চলে যায়।
পরবর্তীতে সেই রিসোর্টে এবং পার্শ্ববর্তী মহাসড়কসহ বিভিন্ন জায়গায় হেফাজত কর্মীরা বিক্ষোভ, ভাঙচুর করে।মামুনুল হক দাবী করেন জিজ্ঞাসাবাদের নামে কিছু মানুষ তাকে ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে হেনস্তা করেছেন। এই ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উক্ত নারীর প্রকৃত নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা; মামুনুল হক ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসে বলেন; তাদের মধ্যে একটি মানবিক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি সেখানে দাবী করেন হাফেজ শহিদুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শহিদুল এবং শহিদুলের স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের পরে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি শহিদুলের সাবেক পত্নীকে বিবাহ করেন।
৪ এপ্রিল সংসদে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপের উদ্ধৃতি দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন উক্ত নারী মামুনুল হকের স্ত্রী নন একই সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মামুনুলের কৃতকর্মের সমালোচনা করে বিনোদনের অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেন।
৪ এপ্রিল মামুনুল হকের বিরুদ্ধে আপত্তিকর পোস্ট দেওয়ায় সুনামগঞ্জে এক যুবলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ৫ এপ্রিল ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুল হকের পক্ষ নিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা পুলিশের এক এএসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একইদিন সোনারগাঁওয়ের ওসিকে বদলি করা হয়।
সর্বশেষ গ্রেফতার
আজ রোববার (১৮/০৪/২০২১) দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের পর তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের কার্যালয়ে নেয়া হয়।
এসময় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. হারুণ আর রশিদ বলেন, আপাতত মোহাম্মদপুর থানার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। অন্য মামলার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আগামীকাল তাকে আদালতে তোলা হবে। তবে এর আগ পর্যন্ত তাকে তেজগাঁও থানায় রাখা হবে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিমের যৌথ অভিযানে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৩ সালের শাপলা চত্বর ঘটনাতেও তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।।