তীব্র তাপদাহে বৃষ্টিপ্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ পড়ার নিয়ম
আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে ফলবতী বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমি দ্বারা পৃথিবী সুশোভিত করেছেন। তিনি মানুষ ও প্রাণীজগতের জীবনধারণের সব উপকরণ পরিমিতভাবে যথাস্থানে স্থাপন করে রেখেছেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে ভারী বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা আমি সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদ্গম করি, অনন্তর তা হতে সবুজ পাতা উদ্গত করি, পরে তা হতে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করি এবং খেজুরগাছের মাথি হতে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি আর আঙুরের উদ্যান সৃষ্টি করি এবং জলপাই ও দাড়িম্বও; এরা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও; লক্ষ করো! এর ফলের প্রতি যখন তা ফলবতী হয় এবং এর পরিপক্বতাপ্রাপ্তির প্রতি। বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ৯৯)
পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য বন-জঙ্গল ও গাছপালা অতি প্রয়োজনীয়, যা মানুষ নির্বিচারে ধ্বংসে মেতেছে। মানবজাতি জীবনধারণের জন্য সর্বাবস্থায় প্রয়োজনীয় বৃক্ষরাজি ও গাছপালা বনায়ন ও রোপণ না করে কেবল কেটে কেটে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে, ফলে পৃথিবীতে বৃষ্টিপাতের অভাব হচ্ছে। মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে এবং পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
বৃষ্টি না হওয়ায় তাপপ্রবাহে দেশের মানুষের বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্ট হতে থাকলে প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর দরবারে পানি প্রার্থনা করে দোয়া করা সুন্নত। একেই আরবিতে বলা হয় ‘ইসতিসকা’ অর্থাৎ পানি প্রার্থনা করা।
সহীহ মুসলিম শরীফ ৩য় খণ্ড দশম অধ্যায় (ইস্তিসকার বা বৃষ্টির নামাজ)
১৯৪৭-১৯৫৬ হাদীসঃ
১৯৪৭: আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি আব্বাদ ইবনে তামীমকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ মাযেনীকে বলতে শুনেছি- রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজের নির্ধারিত স্থানে চলে গেলেন এবং সেখানে পৌঁছে ইসতেসকার নামাজ পড়লেন।
যখন কেবলামুখী হলেন, তিনি তাঁর চাদরটা উল্টিয়ে নিলেন।
ইস্তিসকার (বৃষ্টির দুআ) সর্বসম্মতিক্রমে সুন্নাত। তবে সেজন্য নামাজ পড়া সুন্নাত কিনা এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবু হানীফার মতে, এ নামাজ সুন্নাত নয়, বরং দুআই যথেষ্ট। বিপুল সংখ্যক সাহাবী-তাবেঈ’ এবং অধিকাংশ উলামার মতে, এ নামাজও সুন্নাত। আবু হানীফা (র.) নিজ মতের সপক্ষে ওইসব হাদীস পেশ করেন, যেগুলোতে এ নামাজের কোনো উল্লেখ নেই। যেমন উপরোক্ত হাদীস। আর বিশেষজ্ঞ আলেমরা ওই সব হাদীসের ভিত্তিতে সুন্নাত প্রমাণ করেন যাতে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইস্তিসকার জন্য দুরাকাত নামাজ পড়েছেন।
১৯৪৮: আব্বাদ ইবনে তামীম (রা.) থেকে তাঁর চাচার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) নামাজের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে ইসতেসকার দুআ করলেন এবং কেবলামুখী হয়ে তাঁর চাদরটা উল্টিয়ে দিলেন। অতঃপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।
১৯৪৯: আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ আনসারী (রা.) জানিয়েছেন যে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসতিসকার উদ্দেশে মাঠের দিকে বের হয়ে গেলেন। যখন তিনি দুআ করার ইচ্ছা করলেন, কেবলামুখী হলেন এবং নিজের চাদর উল্টিয়ে দিলেন।
১৯৫০: আব্বাদ ইবনে তামীম মাযেনী থেকে তাঁর চাচার সূত্রে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন| তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন ইস্তেসকার উদ্দেশে বের হলেন। তিনি লোকদের দিকে পিঠ রেখে আল্লাহর কাছে দুআ করতে লাগলেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে তার চাদরটা উল্টিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।
১৯৫১: আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) দুআ করার সময় উভয় হাত উপরে উঠাতে দেখেছি। এতে তার বগলের শুভ্রতা পরিদৃষ্ট হচ্ছিল।
১৯৫২: আনাস ইবনে মালিক (র.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) ইস্তিসকার দুআ করেছেন এবং দুআর সময় তিনি উভয় হাতের পিঠ দ্বারা আকাশের দিকে ইশারা করেছেন।
১৯৫৩: আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) তার কোনো দুআয় হাত উঠাতেন না। কেবল ইস্তিসকায় হাত উঠাতেন। এমনকি এতে তাঁর বগলের শুভ্রতা পরিদৃষ্ট হতো। তবে আবদুল আ’লা তাঁর বর্ণনায় বলেছেন।
১৯৫৪: কাতাদা থেকে বর্ণিত। আনাস ইবনে মালিক (রা.) তাঁদের নবী (সা.) থেকে উপরের হাদীসের অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করে শুনিয়েছেন।
১৯৫৫: আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি জুমার দিন মসজিদে নব্বীতে দারুল কাযার দিকে স্থাপিত দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। সে রাসূলুল্লাহর (সা.) দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! (অনাবৃষ্টির ফলে) মালসম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অতএব আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন তিনি আমাদের মেঘদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) দুই হাত উঠিয়ে দুআ করলেন,”হে আল্লাহ! আমাদের মেঘ দিন। ’’ (আমাদের ফরিয়াদ শুনুন! আমাদের ফরিয়াদ শুনুন!) আনাস (রা.) বলেন, খোদার কসম! এসময় আসমানে কোনো মেঘ বা মেঘের চিহ্নও ছিলনা। আর আমাদের ও সালা’ পাহাড়ের মাঝে কোনো ঘর-বাড়ি কিছুই ছিলনা। (ক্ষণিকের মধ্যে) তাঁর পেছন থেকে ঢালের ন্যায় একখ- মেঘ উদিত হলো। একটু পর তা মাঝ আকাশে এলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং বৃষ্টি শুরু হলো।
রাবীদ্বয় বলেন, এরপর খোদার কসম, আমরা সপ্তাহকার যাবৎ আর সূর্যের মুখ দেখিনি। অতঃপর পরবর্তী জুমায় আবার এক ব্যক্তি ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। সে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! মাল সম্পদ সব বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অতএব আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন বষ্টিপাত বন্ধ করে দেন। রাবী বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আবার হাত উঠিয়ে দুআ করলেন, ”হে আল্লাহ! আমাদের অবস্থা পাল্টে দাও আমাদের ওপর এ অবস্থা চাপিয়ে দিওনা। হে আল্লাহ! পাহাড়ি এলাকায়, মালভূমিতে মাঠের অভ্যন্তরে ও গাছপালা গজানোস্থলে তা ফিরিয়ে নিয়ে যাও। ’’ এরপর বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বের হয়ে সূর্য কিরণে হাঁটাচলা করতে লাগলাম। শরীক বলেন, আমি আনাস ইবনে মালিককে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যক্তি কি প্রথম ব্যক্তি। আনাস (রা.) বললেন, আমার জানা নেই।
১৯৫৬: আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যামানায় মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হলো। ওই সময় একদিন জুমার দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে উপবিষ্ট হয়ে লোকদের সামনে জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন। এক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! ধনসম্পদ বরবাদ হয়ে গেল, সন্তান সন্ততি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে। অবশিষ্ট হাদীস পূর্বোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। এ বর্ণনায় আরও আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ”আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা-আলাইনা’’ রাবী বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) হাত দিয়ে যেদিকেই ইশারা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেদিক ফর্সা হয়ে গেছে।
এমনকি আমি মদীনাকে আয়নার ন্যায় পরিষ্কার দেখতে পেলাম। এদিকে, ”কানাত’’ নামক প্রান্তরে একমাস যাবত পানির ধারা বয়ে গেল। যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ এসেছে সে-ই অতি বৃষ্টির সংবাদ দিয়েছে।
বৃষ্টির জন্য প্রার্থনায় সম্মিলিতভাবে জামাতে দুই রাকাত ‘ইসতিসকার নামাজ’ আদায়ের জন্য দেশের সব এলাকার মুসলমান পুরুষকে অবনত মস্তকে কাকুতি-মিনতির সঙ্গে মাঠে বের হওয়া দরকার। ইমাম সাহেব কিবলামুখী দাঁড়িয়ে হস্তদ্বয় প্রসারিত করে রহমতের বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করবেন এবং মুসল্লিরাও কায়মনোবাক্যে দোয়া করবেন। সবাইকে পাপমোচনের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিখাদ অন্তরে তওবা ও ইস্তেগফার করতে হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন, আমীন।