Lead Newsজাতীয়শিক্ষাঙ্গন

সান্ধ্য কোর্স ছাড়াও হরেক রকম কোর্স পড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রদের আপত্তি উপেক্ষা করে দেড় দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া সান্ধ্য কোর্স এখন ডালপালা মেলে আরও অনেক নাম নিয়েছে; বাণিজ্যিকভাবে চলা সে সব কোর্সে প্রতিবছর ভর্তি হচ্ছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যাদের অধিকাংশই পেশাজীবী।

এই সব কোর্স নিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অসন্তোষ প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।

এর পরপরই সান্ধ্যকালীন কোর্সে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি না নিতে বিভিন্ন বিভাগের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকার আরেক সরকারি বিশ্ববিদ্যায়ল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির ওই বক্তব্য, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স চালু হয় ২০০২ সালে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। সে সময় অনুষদের চারটি বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু করা হয়। তবে এখন তা অনেক গুণ বেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৪২টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ইভিনিং মাস্টার্স, ডিপ্লোমা কোর্স, প্রফেশনাল কোর্স, স্পেশালাইজড মাস্টার্স, এক্সিকিউটিভ মাস্টার্সসহ বিভিন্ন নামে প্রায় ৮০টি কোর্স চালু রয়েছে। এগুলো সবই নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরে।

এসব কোর্স নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শিক্ষকরা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বক্তব্যেও সে বিষয়টি উঠে আসে। তিনি বলেছিলেন, কিছু শিক্ষক নিয়মিত কোর্স পড়ানোর বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন।

“কিন্তু ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে তারা খুবই সিরিয়াস। কারণ এগুলোতে নগদ প্রাপ্তি থাকে।”

সান্ধ্য কোর্সের জন্য সন্ধার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ থাকে না মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত কোর্স ছাড়াও বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোর্স পড়ে প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এতে ডিগ্রিধারীদের লাভ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক ঠিকই লাভবান হচ্ছেন।

“তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। ফলে শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”

রাষ্ট্রপ্রধানের এই বক্তব্যের দু্ই দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যাগুলোতে সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ, উপাচার্যদের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন এবং নতুন বিভাগ ও পদ সৃষ্টিতে ইউজিসির পূর্বানুমোদন গ্রহণ, নিয়োগ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসরণসহ ১৩টি নির্দেশনা দেয়।

সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, “সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বিধায় সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ হওয়া দরকার।”

সান্ধ্য কোর্স নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান ও ইউজিসির নির্দেশনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোর্সগুলো বন্ধের দাবিতে আবারও সরব হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র প্রতিনিধিরা।

এ বিষয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের সময় সকল ছাত্র সংগঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল, সান্ধ্য কোর্স বাতিল করার। আর এটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাওয়া নয়, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাইট কোর্সগুলো বন্ধ করা, সূত্র বিডি নিউজ।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্স বন্ধের জন্য আমরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন প্রশাসনকে একাধিকবার বলেছি। তখন প্রশাসন আসলে ওইভাবে কর্ণপাত করেনি বিষয়টি নিয়ে। এখন সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি বলার পর আমরা মনে করি, আমরা এতদিন যে দাবি করে আসছিলাম সেটি আরেকটু জোরাল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখন এটাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। আমরা স্পষ্টভাবেই বলেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন এটিকে বাতিল করে।”

এই সব কোর্স বন্ধ না হলে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়ে নূর বলেন, “এখানে যেহেতু শিক্ষকদের একটা অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত, সুতরাং অনেকে এটার বিপক্ষে অবস্থান নেবে। সেখান থেকে যদি প্রশাসন সিদ্ধান্তে না আসতে পারে তাহলে ছাত্ররা হয়ত এটা বন্ধের দাবিতে প্রয়োজনে আন্দোলন করব।”

ডাকসুর সভায় সান্ধ্য কোর্স বন্ধের বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন এই ছাত্র সংসদের এজিএস ও ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি প্রশাসনিক জটিলতার অজুহাতে এই প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে কিংবা ইউজিসি যে নির্দেশনা দিয়েছে এটাতে যদি স্বায়ত্তাশাসনের অজুহাত ব্যবহার করে এই বিষয়টাকে দীর্ঘায়িত করতে চায়, সেটা ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।

“সেক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ আন্দোলন করে সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।”

সাদ্দাম বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বাণিজ্যিক কোর্স চালু রাখা যাবে না। শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন মনে করলে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণমূলক কোর্স রাখা যেতে পারে।

“এর জন্য শিক্ষাবিদদের দিয়ে একটি নীতিমালা গঠন করতে হবে। যেটা অবশ্যই বাণিজ্যিক হবে না।”

সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সান্ধ্যকালীন, প্রফেশনাল, এক্সিকিউটিভ বিভিন্ন কোর্স সংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে এক ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটার আলোকে আমি ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।”

রাষ্ট্রপতির সেই নির্দেশনা মোতাবেক এই কোর্সগুলো পর্যালোচনার জন্য গত মে মাসে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচটি অনুষদের ডিনের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে বলে জানান উপাচার্য।

“আশা করি, খুব শিগগিরই সেই কমিটির সুপারিশ পেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারব।”

সান্ধ্য কোর্স বন্ধে ইউজিসির নির্দেশনার বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, “শুধু সান্ধ্যকালীন বিষয়টি বললেই হবে না, এখানে আমাদের প্রফেশনাল, এক্সিকিউটিভ বিভিন্ন বিষয় আছে সেগুলো নিয়মনীতি অনুসরণ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা ও জাতীয় প্রয়োজন বিবেচনা করেই আমাদের পরিশীলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবে আমরা মূলধারার শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়ন ও উৎকর্ষতা সাধনে এগিয়ে যাব।”

পর্যালোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইলে কমিটির প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে আমরা এখনও সুপারিশ করার মতো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। আশা করছি, এক মাসের মধ্যে আমরা উপাচার্যের কাছে সুপারিশ দাখিল করতে পারব।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − eleven =

Back to top button