Breakingআন্তর্জাতিক

এরদোগান-বাইডেন বৈঠকঃ জট খোলার লক্ষণ নেই, উত্তেজনা চলবে বলে ধারণা

ন্যাটো সামরিক জোটের শীর্ষ বৈঠকের ফাঁকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিপজ্জনক ক্রমাবনতি ঠেকাতে ব্রাসেলসে সোমবার মুখোমুখি বসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান।

যার হাসিমুখের ছবি বিরল, সেই এরদোগানকে জো বাইডেনের সামনে হাসিতে বিগলিত হতে দেখা গেছে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক এই দুই প্রেসিডেন্ট একান্তে বসে কথা বলেছেন। পরে দু’জনেই পৃথক পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সম্পর্ক উন্নয়নে তাদের মধ্যে ‘ফলপ্রসূ, গঠনমূলক’ আলোচনা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোগান এমন মন্তব্যও করেছেন যে এমন কোনো বিষয় তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকতে পারে না, যার কোনো সমাধান নেই।

কিন্তু সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়াদের প্রতি মার্কিন সমর্থন কিংবা তুরস্কে রাশিয়ায় তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা মোতায়েন করার মতো স্পর্শকাতর যেসব ইস্যুতে এক সময়কার ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে, সেগুলোতে কোনো রফা হয়েছে কিনা বা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কিনা, তার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি ওই বৈঠকের পর।

বৈঠক নিয়ে জো বাইডেন কথা বলেছেন খুবই সামান্য। রাতে তার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বুধবার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে তার আসন্ন বৈঠক নিয়ে কথা বলতে তিনি যতটা সময় ব্যয় করেছেন, তার ছিটেফোঁটাও তিনি ব্যয় করেননি এরদোগানের সাথে তার বৈঠক নিয়ে কথা বলতে।

ওই তুলনায় প্রেসিডেন্ট এরদোগান বরং ছিলেন কিছুটা খোলামেলা।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি যেসব বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে, তা নিয়েও কথা বলেছি।

এরদোগান ইঙ্গিত দেন যে সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজিকে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থন নিয়ে তুরস্কের আপত্তির কথা তিনি বলেছেন। সন্ত্রাস দমনে দ্বৈত নীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক সন্ত্রাসীকে দমনে আরেক সন্ত্রাসীকে সমর্থন করা যায় না।

কিন্তু ওয়াইপিজির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার নিয়ে বাইডেন কোনো প্রতিশ্রুতি তাকে দিয়েছেন কিনা, তা অবশ্য বলেননি এরদোগান।

বিরোধের যত কারণ

সৈন্য সংখ্যার বিচারে তুরস্ক ন্যাটো জোটের দুই নম্বর সামরিক শক্তি। তুরস্কে ন্যাটো এবং আমেরিকার একাধিক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে পারমানবিক অস্ত্র পর্যন্ত মোতায়েন করা রয়েছে।

কিন্তু সামরিক এই ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়েছে বেশ কিছু দিন ধরে, এবং কেউই আশা করেননি যে একটি বৈঠকেই জমাট বাধা বরফ মুহূর্তে ম্যাজিকের মত গলে যাবে।

বৈঠকের আগে লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেনিও তাদের এক পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে বলেছিল যে দুই নেতার কেউই এখন অন্যকে চটাতে চাইবেন না এটা ঠিক, কিন্তু বৈঠক থেকে এরদোয়ান গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুবিধা অর্জন করবেন, সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

বড় কোনো সমস্যার কোনো ধরণের সুরাহা এই বৈঠক থেকে হবে না, যার অর্থ যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কে উত্তেজনা চলতে থাকবে।

কিছু পর্যবেক্ষক অনেকটা একই কথা বলেছেন, তাদের যুক্তি, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চলমান ‘ সঙ্কটের পেছনের কারণগুলো খুবই স্পর্শকাতর। এর পেছনে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা এবং এরদোগানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।

তুরস্কে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এরদোয়ানের মধ্যে সন্দেহ ঢুকেছে যে আমেরিকা এবং কয়েকটি পশ্চিমা দেশ তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তৎপর।

তার এই সন্দেহ এবং ক্ষোভ সরাসরি প্রকাশ পায় যখন আমেরিকার শত নিষেধ-আপত্তি সত্ত্বেও ২০১৯ সালে এরদোগান রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেনেন।

আমেরিকার কথা, ন্যাটো জোটের কোনো দেশে বিশেষ করে যেখানে মার্কিন বিমানঘাঁটি এবং মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে, কোনো রুশ কৌশলগত অস্ত্র মোতায়েন করা হলে জোটের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

তুরস্ক অবশ্য সব সময় বলে আসছে যে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি মতো প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা বিক্রি না করায় তাদেরকে বাধ্য হয়েই রাশিয়ার কাছে যেতে হয়েছে।

কিন্তু আমেরিকা এবং ন্যাটো জোটের অনেক সদস্যের কাছে তুরস্কের ওই সিদ্ধান্ত ছিল মিত্রদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। শাস্তি দিতে আমেরিকা তুরস্কের কাছে ১০০ অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি বাতিল করে দেয়।

সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজি’র প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো চটে যায়, কারণ তুরস্ক ওয়াইপিজি’কে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকে’র সহযোগী হিসাবে দেখে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০১১ সালে ব্যবসা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বৈঠকে যোগ দিতে বাইডেন যখন তুরস্কে যান, এরদোগান তখন অসুস্থ ছিলেন। তাকে দেখতে আঙ্কারায় তুরস্কের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাইডেন। খুব অল্প সময় থাকার কথা থাকলেও দু’ঘণ্টা ধরে তারা দু’জন কথা বলেছিলেন।

২০২০ সালে তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন তুর্কি প্রেসিডেন্টকে একজন ‘স্বৈরাচারী’ হিসেবে অবিহিত করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ তুরস্কে তার বিরোধীদের সমর্থন করা।

স্বভাবতই এসব কথা পছন্দ হয়নি তুরস্কের নেতার। নির্বাচনে জেতার পর বাইডেনকে অভিনন্দন জানাতে রাশিয়ার পুতিন বা চীনের শি জিনপিংয়ের মতো পাঁচ দিন সময় নেন এরদোয়ান।

তুরস্ক ন্যাটো জোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেও ক্ষমতা নেওয়ার পর এরদোগানের সাথে কথা বলতে তিন মাস সময় নেন বাইডেন।

এপ্রিলে যখন প্রথম তিনি এরদোগানকে ফোন করেন, তখন সেই আলাপ মোটেও সুখকর ছিল না। বাইডেন সেদিনই এরদোগানকে জানান যে, তিনি অটোম্যান শাসন আমলে ঘটা আর্মেনিয়ায় গণহত্যার অভিযোগকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন।

তবে সোমবারের বৈঠকের আগে দুই শিবির থেকেই সতর্ক কথাবার্তা শোনা গেছে। এরদোগান রোববার বলেন, তিনি পুরনো সমস্যা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চান, তবে বাইডেনের মুখ থেকে ‘কোনো পূর্বশর্ত’ শুনতে তিনি আগ্রহী নন।

নমনীয় হচ্ছেন এরদোগান?

পর্যবেক্ষকরা মতে, কোভিড মহামারীর জেরে তুরস্কের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়েছে এবং এরদোয়ান মনে করছেন যে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য আমেরিকা এবং পশ্চিমাদের সাহায্য-সমর্থন জরুরি।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নিজের দেশের অর্থনীতিতে যত সঙ্কট বেড়েছে, পশ্চিমা-বিরোধী বাগাড়ম্বর ততই কমিয়েছেন এরদোয়ান।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান তিনি বন্ধ করেছেন। রাশিয়া অখুশি হবে জেনেও পোল্যান্ডের কাছে ড্রোন বিক্রি করেছেন। এমনকি রাশিয়ার সাথে চলতি উত্তেজনায় ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টডিজের বিশ্লেষক র‌্যাচেল ইলহাস বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, আর্মেনিয়ায় তুরস্কের গণহত্যার অভিযোগকে বাইডেনের স্বীকৃতির পর তার প্রতিবাদ করলেও খুব বেশি বাড়াবাড়ি এরদোগান যে করেননি, তা থেকে বোঝা যায় সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি আগ্রহী।

দু’বছর পর তুরস্কে নির্বাচন এবং তার আগে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এরদোগানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ কারণেই হয়তো গত মাসে আমেরিকার অনেকগুলো কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদের সাথে এক ভার্চুয়াল সভায় এরদোগান আশ্বাস দেন যে ১৪ জুন ব্রাসেলসে তার সাথে বাইডেনের বৈঠক হবে একটি ‘মোড় ঘোরানো ঘটনা’।

তবে তার আপসের ইঙ্গিতে বাইডেন প্রত্যাশামত সাড়া না দিলেও এরদোয়ানের হাতে এখনো বেশ কিছু তুরুপের তাস রয়েছে।

তুরস্কের তুরুপের তাস

এর একটি আফগানিস্তান। সোমবারের বৈঠকে এরদোগান আমেরিকানদের বলেছেন ‘মিত্রদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক সহযোগিতা’ পেলে তুরস্ক আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি অব্যাহত রাখবে। এক্ষেত্রে, পাকিস্তানের সাথে সমন্বয় করবে তারা।

জানা গেছে, ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর বিশেষ করে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধানে বেশ ক’মাস আগে তুরস্কের সাহায্য চেয়েছিলেন আফগান বিষয়ক মার্কিন দূত যালমে খালিলযাদ।

তালেবান অবশ্য বলেছে যে অন্য ন্যাটো দেশের মতো তুরস্কের সেনাবাহিনীকেও আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তালেবানের এই আপত্তি তুরস্ককে আমেরিকার সাথে মীমাংসায় বাড়তি সুবিধা দিতে পারে।

এছাড়া, লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে তুরস্ক সম্প্রতি তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে, যা আমেরিকার দৃষ্টি কেড়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা, তুরস্কে মার্কিন বিমান বাহিনীর একাধিক ঘাঁটি রয়েছে, যার ভেতর এক ইনজিলিক বিমান ঘাঁটিতে ৫,০০০-এর মতো মার্কিন সেনা এবং ৫০টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা আছে। পঞ্চাশের দশক থেকে আমেরিকা এবং ন্যাটো মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায়, এমনকি আফগানিস্তানে তাদের সামরিক অভিযানগুলোয় তুরস্কের এই ঘাঁটিকে ব্যবহার করে আসছে।

এরদোগান একাধিকবার এমন হুমকি দিয়েছেন যে ইনজিলিক বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন বিমান বাহিনীর ইউনিটকে তিনি বের করে দেবেন। শেষবার তিনি এই হুমকি দিয়েছেন আর্মেনিয়ায় গণহত্যার অভিযোগকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার পর।

সুতরাং বেশি চাপ দিলে এরদোগান এবং তুরস্ক বিগড়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও আমেরিকার কোনো কোনো মহলের মধ্যে রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজে) তুরস্ক প্রকল্পের প্রধান নিগার গোসেলকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছেন, এরদোগানকে ক্রমাগত শায়েস্তা করে তুরস্ককে কি সাথে রাখতে পারবে আমেরিকা?

বেশি চাপাচাপি করলে এরদোয়ান আরো বেশি করে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়তে পারেন, অর্থনীতিতে সাহায্যের জন্য চীনের কাছে ঘেঁষতে পারে। এফ-৩৫ বিমান না পেলে এক সময় তিনি হয়তো রাশিয়ার সুখয় বিমান কিনবেন, এসব সম্ভাবনার কথা পশ্চিমা দেশের বিশ্লেষক মহলে হরদম আলোচনা হচ্ছে।
সূত্রঃ বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + 18 =

Back to top button