আফগানযুদ্ধে মার্কিনীদের স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু চারগুণ বেশি; রহস্য উন্মোচিত
দীর্ঘ দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে যুদ্ধ করার পরও যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে হচ্ছে। কিন্তু কৌতুহলী মনে জিজ্ঞাসা, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটি তাদের সাথেই আলোচনা ও চুক্তি করছে কেন, যাদের সাথে তারা গত ২০ বছর ধরে যুদ্ধ করে আসছে?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মূল রহস্য বেরিয়ে এসেছে। মোটা দাগে যেটা জানা গেছে, তা হলো – যুদ্ধে যতটা না মার্কিন সেনাদের ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়েও তারা বেশি ভেঙে পড়েছে মানসিকভাবে।
জানা যায়, যুদ্ধের কারণে মারা গেছে ৭ হাজার ৫৭ জন সেনা আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ৩০ হাজার ১৭৭ মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করে – যা যুদ্ধে নিহত মোট সেনার থেকে অনেক বেশি। তাই বিপুলসংখ্যক মার্কিন সেনার আত্মহত্যার কারণেই আফগানিস্তান থেকে পিছু হটেতে বাধ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
মর্কিন প্রতিষ্ঠান বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক মার্কিন সেনা মানসিক রোগে ভুগছে। এ মানসিক রোগটি ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস সিনড্রম‘ (পিটিএসডি) নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটির ওই সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে যে ইরাক ও আফগানিস্তানে নিয়োজিত সেনা আর ওই এলাকা থেকে দায়িত্ব শেষে ফিরে আসা সেনারা পিটিএসডি মানসিক রোগে ভুগছে, তাদের সংখ্যা ৬০ হাজার আর শতকরা হিসাবে তা ১৩.৫ শতাংশ।
এছাড়া মোট মার্কিন সেনাদের মধ্যেকার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পিটিএসডি মানসিক রোগে ভুগছে।
মানসিক রোগে আক্রান্ত মার্কিন সেনাদের মোট সংখ্যা হলো পাঁচ লাখ, তাদের অনেককেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মূলত, এ কারণেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তালেবানের সাথে চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করেন।
আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের মূল কারণ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করে এবং আফগান যুদ্ধে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করার পরও কেন আফগান তালেবানের সাথে চুক্তি করতে হলো? ন্যাটো সেনাদের সহায়তা পাওয়ার পরও কেন তারা আফগান যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে? এসব তথ্য পাওয়া গেছে ওই সমীক্ষায়। যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর ধরে যা চেপে রাখতে চেয়েছে তা প্রকাশ করেছে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের ৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত ২০ বছর ধরে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে নিয়োজিত মার্কিন সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার আরো বেশি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শুরু করা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। ২০০১ থেকে চালু করা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩০ হাজার ১৭৭ মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার মাধ্যমে মরে যাওয়া সেনাদের মধ্যে যেমন দায়িত্বরত সেনারা আছে, তেমনি যুদ্ধফেরত সেনারাও আছে। অপরদিকে যুদ্ধে মাত্র সাত হাজার ৫৭ জন মারা গেছেন।
বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতগুলো যুদ্ধে লড়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ ছিল আফগান যুদ্ধ। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহু দূরে থাকা এসব মার্কিন সেনারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ দিন যুদ্ধ করার পর আফগানিস্তানে যুদ্ধরত মার্কিন সেনা ও ভাড়াটে সেনারা যেমন ‘ব্লাক ওয়াটার’ বুঝতে পারে যে এ যুদ্ধটা আসলে লক্ষ্যভ্রষ্ট এক অনর্থক কর্মকাণ্ড।
অপরদিকে আফগান তালেবান উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করছে। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার কোনো ঘটনা নেই। তারা মাথা ঠান্ডা রেখে এবং ধৈর্য ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাদের বিরুদ্ধে। মার্কিন সেনাদের মতে তালেবান হলো বিশৃঙ্খল বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যাদের কাছে যুদ্ধ করার জন্য সঠিক জুতাটাও ঠিকমতো নেই। এমন দুর্বল কিন্তু মানসিকভাবে শক্তিশালী গেরিলাদের কাছেও মার খেয়ে এখন আফগানিস্তান ছাড়ার বিষয়ে তাড়াহুড়া করছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্ভবত এ কারণেই আফগানিস্তানকে বলা হয় সম্রাজ্যবাদের কবরস্থান। এখানে ব্রিটিশ ও সোভিয়েত সম্রাজ্য কবরস্থ হওয়ার পর এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবর রচিত হচ্ছে।
সূত্র : দ্যা মুসলিম মিরর