বিবিধ

মানিকগঞ্জের ‘হাজারি গুড়ের’ সুনাম ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের মুখে!

মানিকগঞ্জের হাজারি গুড় অন্য সব গুড়ের চেয়ে বেশ আলাদা। এটি হাতে নিয়ে আলতোভাবে চাপ দিলেই গুঁড়া হয়ে যায়। মাতিয়ে তোলে এর সুঘ্রাণ। এখনো সেখানকার হাজারি পরিবার ধরে রেখেছে তাদের বংশপরম্পরার এই ঐতিহ্যবাহী গুড় তৈরির পদ্ধতি। প্রচণ্ড শীত চলাকালীন সময়ে তৈরি করা হয় বিখ্যাত এই হাজারি গুড়।

রানীর মুখে গুড়ের প্রশংসা  

হাজারি পরিবারের দাবি, ব্রিটিশ আমলে রানী প্রথম এলিজাবেথের ভারতবর্ষ সফরের সময় এই গুড় তাকে খেতে দেয়া হয়। তিনি গুড় হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে চাপ দেয়া মাত্রই তা ভেঙে হাজারটি গুড়া হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রানী গুড়ের সুবাসে মুগ্ধ হয়ে মুখে নিয়ে খেয়ে দেখেন। এরপর থেকেই এই গুড়ের নাম হাজারি গুড়। বাংলার লোকমুখে আরো প্রচলিত রয়েছে, রানী এই গুঁড়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেইসঙ্গে বাংলায় হাজারি লিখিত একটি সিল উপহার দেন। যা দিয়ে গুড়ের গায়ে এখনো সিল দেয়া হয়।

ভারতবর্ষে তখন সম্রাট আকবরের স্বর্ণযুগ। ওদিকে ইউরোপ জুড়ে রানী প্রথম এলিজাবেথের বিকাশপর্ব। মনোহর আবহাওয়া ও নান্দনিক প্রকৃতির জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের ‘জান্নাতাবাদ’ খ্যাত এই বঙ্গভূমির সুনাম তখন আটলান্টিকের ওপারেও বিস্তৃত। অন্তত চারশ’ বছর আগের কথা। শত বছরের জনশ্রুতি মতে, মানিকগঞ্জ অঞ্চলের গুড়ের ঘ্রাণ ও স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন রানী। গুণমুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এ গুড়ের নাম।

মানিকগঞ্জে গুড়ের বাজারে খেজুর গুড়ের বিশাল পসরা বসলেও হাজারি গুড় সেখানে অনন্য। তাই এর দাম প্রচলিত পাটালি গুড়ের তুলনায় পাঁচ থেকে দশগুণ। জানা গেছে, এক কেজি হাজারি গুড় এক হাজার থেকে বারোশ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। কম করে হলেও দেড়শ’ বছরের বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে সমানভাবে এর সুনাম রয়েছে। এমনকি সরকারিভাবে এই গুড়ের সুনামকে স্বীকৃতি দিতে ‘ঝিটকার হাজারি গুড়’ নাম দিয়েই এ জেলার ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। এ অঞ্চলের প্রায় শ’খানেক পরিবার হাজারি গুড়ের ওপর  নির্ভর করে তাদের জীবিকা চালিয়ে আসছে।

হাজারি গুড়ের রহস্য

ভোরের আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসার আগেই ঘুম ভেঙে যায় সেখানকার গাছি এবং তাদের গৃহিণীদের। গাছিরা চলে যায় খেজুর গাছ থেকে হাড়ি ভর্তি রস আনতে। আর গৃহিণীরা রস জাল করার জন্য প্রস্তুতি নিতে চুলার পাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জনশ্রুতি রয়েছে, গাছি ও গৃহিণীদের এই গুড় তৈরি ও বিক্রির ব্যস্ততা অন্তত দেড়শ’ বছরের।

স্থানীয়দের মতে, এ গুড়ের উৎস খেজুরের রস। গাছির রস নামানো থেকে শুরু করে গুড় তৈরির মধ্যে রয়েছে আদি এক প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও হাজারি গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন নেই। ভালো গুড়ের জন্য দরকার খুব ঠাণ্ডা রোদ, ঝলমলে আবহাওয়া। হাঁড়িগুলো গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হয়। কাক ডাকা ভোরেই গাছে উঠে রস নামাতে হয়। সকাল আটটার মধ্যে গুড় বানানো শেষ।

বেশি শীত অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গুড় উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। আগের দিন বিকালে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেয়া হয়। পরদিন ভোরে গাছ থেকে রস নামিয়ে ছেঁকে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির তৈরি জালা অথবা টিনের তৈরি পাত্র চুলায় জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাশের খড়ি। এ গুড় দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না।

হাজারি গুড় নিয়ে প্রচলিত উপকথা

মিষ্টি গন্ধ ও মনোহর স্বাদের এ হাজারি গুড় নিয়ে এলাকায় প্রচলিত আছে অনেক রকমের উপকথা। প্রায় দুইশ বছর আগে ঝিটকা অঞ্চলে হাজারি প্রামাণিক নামে একজন গাছি ছিলেন যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। একদিন বিকালে খেজুরগাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ এসে তার কাছে রস খেতে চান। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেন, সবে গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এ অল্প সময়ে বড়জোর ১০ থেকে ১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে। তবুও দরবেশ রস খাওয়ার আকুতি জানান এবং তাকে গাছে উঠে হাড়ি নামাতে বলেন।

গাছি তখন খেজুর গাছে উঠে হতবাক হয়ে যান। দেখতে পান, মাত্র কয়েক মিনিটে পুরো হাঁড়ি রসে ভরে গেছে। গাছি হাঁড়িভরা রস নিয়ে নিচে নেমে দরবেশকে রস খাওয়ান এবং তার পা জড়িয়ে ধরেন। তখন দরবেশ গাছিকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাই খাবে এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে।’ বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। ওই দিন থেকেই হাজারি প্রামাণিকের নামেই এ গুড়ের ‘হাজারি’ নামকরণ হয়।

আবার প্রবীণ অনেকের মতে, গাছের রস থেকে বিশেষ কৌশলে সুগন্ধময় সফেদ এ গুড়ের উদ্ভাবন করেছিলেন হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিন হাজারী। প্রকৃত হাজারি গুড় তৈরির গোপন কৌশল একমাত্র তার পরিবারের সদস্যদের মাঝেই রয়ে গেছে। তার নামেই এই গুড়ের নামকরণ হয়েছে ‘হাজারী গুড়’।

মানিকগঞ্জের বিভিন্ন বাড়ি আঙিনা এবং বিভিন্ন কাঁচা-পাকা রাস্তার পথ-প্রান্তে শোভা ছড়ায় সারি সারি খেজুর গাছ। হাজারি গুড় তৈরি হয় সেসব গাছের রস থেকেই। একই এলাকার শতাধিক পরিবার এই হাজারি গুড় তৈরি করেন। এই গুড়ের চাহিদা এতোই বেশি যে, গুড় তৈরি করার কয়েক মাস আগেই অর্ডার নেয়া হয়। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ গাড়ি নিয়ে আসেন গুড় নিতে। তবে আগের মতো এখন আর গুড় তৈরি হয় না। তার কারণ খেজুর গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে। পাশাপাশি রস জ্বাল করার বিশেষ জ্বালানির অভাবও একটা কারণ।

তবে এক যুগ আগেও এই গুড় তৈরিতে এলাকাবাসীর উৎসাহ আরো বেশি ছিল। ক্রমেই সে আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ গুড় তৈরিতে জ্বালানি খরচ বেশি ও সঠিক দাম না পাওয়া। এছাড়া বর্তমান নকল গুড়ে সায়লাব হয়ে পড়েছে। নকল গুড়ে আসল হাজারি গুড়ের সিল লাগিয়ে বাজারে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এরকম অভিযোগের কারণে হাজারি গুড়ের ঐতিহ্য দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে, সূত্র ডেইলি বাংলাদেশ।

আরও জানুনঃ হাস্যরসবাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের তালিকা

Tag: Daily Star Bd, The Daily star bd, Daily star bd today

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − 2 =

Back to top button