তথ্যপ্রযুক্তি

গ্রামীণফোন ইস্যুতে মুখোমুখি টেলিনর-বাংলাদেশ

গ্রামীণফোন ইস্যুতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয় বিশ্বের অন্যতম টেলিকম প্রতিষ্ঠান টেলিনর। রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠানো চিঠিতে সরকারের পাওনা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ না করে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এজন্য ছয় মাস বেঁধে দিয়ে ফল না পেলে আরবিট্রেশনে যাওয়ার হুমকি দেয় টেলিনর।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলছেন এটি লিগ্যাল নোটিস। তবে টেলিনর বলছে, এটি আলোচনার আমন্ত্রণ। এ চিঠি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে টেলিনর ও বাংলাদেশ সরকার।
টেলিননের চিঠির বিষয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ওই নোটিসে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনার বিষয়টি নিয়ে সালিশ (আরবিট্রেশন) চাওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে উকিল নোটিস দেওয়া হয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তা অবহিত করা আছে এবং ফরেন মিনিস্ট্রিসহ সবাই এ বিষয়টি জানে। আমরা আমাদের আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। এই উকিল নোটিসটি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। তার কারণটা হচ্ছে, তারা চাচ্ছে আরবিট্রেশন যেন করা হয়। আরবিট্রেশন করার জায়গা দিয়ে তো আমরা উন্মুক্ত হয়েই আছি। কিন্তু বাংলাদেশের আদালতে মামলা থাকলে আমার তো আদালতের বাইরে আরবিট্রেশন করার কোনো সুযোগ নেই। আমার আদালত যদি আমাকে আরবিট্রেশন করার জন্য হুকুম দেন, আমি আরবিট্রেশন করতে পারব।’
এ বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার টেলিনর গ্রুপের কমিউনিকেশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যানে নুডসেন, মিডিয়া রিলেশন্সের পরিচালক টর্মোড স্যান্সতো ও গ্রুপটির এশিয়া অঞ্চলের কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ক্যাথরিন স্ট্যাং লুন্ডের সঙ্গে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়।

তাদের কাছে দুটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়। এর প্রথমটি হলো বাংলাদেশে তারা রাষ্ট্রের প্রধান তথা রাষ্ট্রপতি বরাবর যে ধরনের চিঠি পাঠিয়েছেন, সেটা অন্য কোনো দেশে করেছেন কি না। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তিন মাসের মধ্যে টেলিনরকে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে বিষয়ে তাদের অবস্থান, সূত্র শেয়ার বিজ।
এ দুটি প্রশ্নের মধ্যে প্রথমটির জবাব দিয়েছেন গ্রুপটির এশিয়া অঞ্চলের কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ক্যাথরিন স্ট্যাং লুন্ড। ই-মেইল বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশের অন্তত ৩০টি দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি রয়েছে। টেলিনর যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ওইসব চুক্তির আওতায়ই নিয়েছে।

তাছাড়া টেলিনর গ্রুপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে কোনো লিগ্যাল নোটিস দেয়নি। বরং উদ্ভূত জটিলতা নিরসনে একটি দ্বিপক্ষীয় সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছে। টেলিনর যে চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে, সে চুক্তি অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রধান বরাবর এ ধরনের চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। এ চিঠি দেওয়াকে আমরা সমস্যাটির সৌজন্যমূলক সমাধানের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখছি। চুক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের চিঠি দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে জটিলতা নিরসনের সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সমাধান না হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সালিশির (আরবিট্রেশন) উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
জবাবে আরও উল্লেখ করা হয়, টেলিনর গ্রুপ বিশ্বাস করে যে, আন্তর্জাতিক কোনো সালিশে যাওয়ার আগেই গ্রামীণফোন ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হবে।
টেলিনরের এ বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘টেলিনর যেটি করেছে এটিকে আমন্ত্রণ পত্র বলে না। দাওয়াতে কখনও টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন থাকে না। তারা একদিকে ইনভাইটেশনের কথা বলছে, অন্যদিকে সেই ইনভাইটেশনে ছয় মাস পর আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে বলে উল্লেখ করেছে। রাষ্ট্রপ্রধানকে এভাবে দাওয়াত করায় আমরা চরম ক্ষুব্ধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘টেলিনর সিঙ্গাপুরের একটি ল’ ফার্মের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রপতিকে যে উকিল নোটিস দিয়েছে, আরবিট্রেশনে যাওয়ার জন্য এটি খুবই দুঃখজনক। তারা ব্যবসা করবে আমাদের দেশে আবার আইন মানবে না তা হয় না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। পাওনা আদায়ের ব্যাপারে গ্রামীণফোনকে চুল পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।

আমরা গ্রামীণফোনকে পাওনা পরিশোধ করতে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে এসেছি। নিয়মের মধ্য দিয়ে আমরা গ্রামীণফোনের প্রতি এখনও সহানুভূতিশীল, আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। আমরা সমস্যার সমাধান করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এর মধ্য থেকে কেউ জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন করতে চাইলে আমরা সেটি করতে পারি না।’
উল্লেখ্য, গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির প্রায় ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা আদায়ে কয়েক দফা চেষ্টা করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তবে বিটিআরসির চিঠিতে অর্থ পরিশোধে সায় দেয়নি গ্রামীণফোন। ফলে সেই টাকা আদায়ে গত জুলাইয়ে গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইডথ কমানো হয়। পরে তা প্রত্যাহার করে জুলাইয়ের শেষদিকে সব ধরনের এনওসি প্রদান বন্ধ করা হয়। এতেও কোনো ফল না পাওয়ায় লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণফোনকে নোটিস পাঠায় বিটিআরসি। ওই নোটিসে গ্রামীণফোনের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না, তা ৩০ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছিল।
এর আগে ২৫ আগস্ট বিটিআরসির দাবিকে অযৌক্তিক দাবি করে নিম্ন আদালতে মামলা করে গ্রামীণফোন। এ মামলায় পাওনা দাবির অর্থ আদায়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চায় কোম্পানিটি। যদিও ২৮ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নামঞ্জুর করেন।
পরে বিষয়টি সমাধানে ৩ অক্টোবর গ্রামীণফোন, বিটিআরসি ও এনবিআরকে নিয়ে আলোচনায় বলেন অর্থমন্ত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। সেই মিটিংয়ে গ্রামীণফোনকে ৩৭ দিনের মধ্যে ২০০ কোটি টাকা দিতে প্রস্তাব করা হয়। প্রথম সপ্তাহে সাত দিনের মধ্যে ১০০ কোটি এবং পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আরও ১০০ কোটি টাকা দিতে প্রস্তাব করা হলেও সেই প্রস্তাবেও সাড়া দেয়নি গ্রামীণফোন।
ওইদিন সংবাদমাধ্যমকে গ্রামীণফোন এক ই-মেইল বার্তায় জানায়, ‘টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের অমীমাংসিত এবং ভিত্তিহীন অডিট দাবির জটিলতা নিরসন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য আমরা অর্থমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমাদের লাইসেন্স বাতিল-সংক্রান্ত বিটিআরসির ভিত্তিহীন শোকজ নোটিসটি যেহেতু তুলে নেওয়া হয়নি, সেহেতু আমরা আমাদের প্রত্যাহার দাবি করেছি।’
তবে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে কোনো অর্থ পরিশোধ না করায় গত ১৮ অক্টোবর কোম্পানিটিতে প্রশাসক বসানোর অনুমোদন দেয় সরকার। এর মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়ে যায়।
যদিও এর মাঝেই গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ বন্ধ হয়নি। কারণ নিম্ন আদালতে ব্যর্থ হয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে আপিল করে প্রতিষ্ঠানটি। এর গ্রহণযোগ্যতার শুনানি নিয়ে ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন এবং ওই অর্থ আদায়ের ওপর দুই মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেন। তবে এ আদেশের বিরুদ্ধে ২৩ অক্টোবর আপিল করে বিটিআরসি, যা চেম্বার বিচারপতির আদালত হয়ে আপিল বিভাগে যায়।
গত ২৪ নভেম্বর বিটিআরসির প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার নিরীক্ষা দাবির নোটিসের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে গ্রামীণফোনকে অবিলম্বে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদেশে বলা হয়, গ্রামীণফোন ওই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাও বাতিল হয়ে যাবে। তখন গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে যে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
মোস্তাফা জব্বার এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোর্ট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধের যে তিন মাস সময়ে দেওয়া হয়েছে এ সময়ের মধ্যেই গ্রামীণফোনকে ওই টাকা পরিশোধ করতে হবে। বাকি টাকাও আইন মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই গ্রামীণফোনকে টাকা পরিশোধ করতে হবে। আইন অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্তে যাব।’
যদিও সর্বশেষ দেশে পরিচালিত বহুজাতিক মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন সমঝোতা পৌঁছাতে না পারায় গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান টেলিনর গ্রুপ সিঙ্গাপুরের একটি ল’ ফার্মের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি পাঠায়। এ নিয়েই টানাপড়েন চলছে টেলিনর ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। তবে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তিন মাসের মধ্যে টেলিনরকে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে বিষয়ে শেয়ার বিজকে ই-মেইল বার্তায় তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি টেলিনর।

আরও খবর দেখুন এখানেঃ কর্পোরেটগ্রামীণ ফোন লিমিটেড

Tag: Grameenphone Share News, Grameenphone News

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

7 − 2 =

Back to top button