জাতীয়

নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে কমছে ইলিশের উৎপাদনঃ গবেষণা

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) সংক্ষেপে জিআই পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি ইলিশ। জিআই পণ্যেও স্বীকৃতির পাশাপাশি ইলিশ উৎপাদনেও বাংলাদেশ পৃথিবীতে প্রথম।

উৎপাদন ধরে রাখায় এখন চ্যালেঞ্জ বলে আশঙ্কা করেছেন গবেষকরা। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে ইলিশের মোট উৎপাদন অনেকাংশে কমেছে। বছরে বছরে যে হারে উৎপাদন বাড়ার কথা ছিল তা হয়নি।

গত ৫০ বছরের পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তন থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘আমেরিকান জার্নাল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’ জার্নালের সর্বশেষ সংখ্যায় ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যানথ্রোপজেনিক ইন্টারফিয়ারেন্স ফর দ্য মরফোলজিক্যাল চেঞ্জেস অব দ্য পদ্মা রিভার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা  ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ৬ জন গবেষক যৌথভাবে এটি পরিচালনা করেন।

গবেষণাটির প্রধান গবেষক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম, সহযোগী গবেষক হিসেবে ছিলেন- ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাইজার আহমেদ সুমন, ময়নসসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ, চাঁদপুরস্থ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিউটের ইলিশ জোরদারকরণ প্রকল্পের প্রধান মো. আবুল বাশার, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊধ্বর্তন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মিলন ও বাকৃবির স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সিরাজুম মুনীর।

গবেষকরা ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ইলিশ উৎপাদনের অভয়াশ্রম পদ্মা নদীর বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করেন। দীর্ঘ ৩ বছরের গবেষণায় তারা দেখেন, গত ৫০ বছরে পদ্মা নদীর পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সরজমিনে তারা দেখতে পান, নদীটির গতিপথ বদলানোসহ সংকুচিত হওয়ার নানাবিধ দিক। স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে তারা এগুলোর সাদৃশ্য পান। সে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা দেখেন, গত ৫০ বছরে পদ্মা নদীটি এখন অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি, উষ্ণায়ন, পলি পড়ার মাত্রা বৃদ্ধি ও দখল-দূষণসহ নানাবিধ কারণে চিরচেনা চেহারা প্রায় হারিয়ে ফেলছে।

নদীটির পরিবেশগত পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখানে অতীতের নানা গবেষণা ও ভূরূপতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্তের সহায়তা নেন। পাশাপাশি নদীর ভূতাত্ত্বিক গঠন, জলপ্রবাহে পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি এবং বিভিন্ন সময়ের তাপ ও বৃষ্টিপাতের মাত্রাও পর্যবেক্ষণ করেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার স্যাটেলাইট ইমেজও বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশের ২১টি আবহাওয়া অফিস থেকে।

গবেষণাটি করতে গিয়ে তারা আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণে ১৯৬৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের তথ্যও পর্যবেক্ষণ করেন। নদীতে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। গবেষকদের ভাষ্যমতে, নদী গতি পরির্বনের সাথে তাপমাত্রার পরিবর্তন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি ও পলি জমে যাওয়ার কারণে পদ্মায় এখন আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। মাছের বংশ বিস্তারে তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে মাছের ডিম ছাড়ার সময়। এর মধ্যে সামান্যতম তারতম্য হলে তা মাছের বংশ বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে বলেও জানান তারা।

প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণ বিশেষ করে নানা অবকাঠামোগত প্রকল্প এবং দখল-দূষণ নদীটিকে পরিবেশগতভাবে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক পদ্মা নদী ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে, যা নদী-তীরবর্তী জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। স্থানে স্থানে নদী সংকুচিত হয়ে পড়ায় মাছের পরিমাণ ক্রমেই কমছে। বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদন যে হারে বাড়ার কথা ছিল, সে হারে তো বাড়েনি বরং কমেছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতেও দেখা যাচ্ছে এ নদীর চ্যানেল অস্বাভাবিক হারে পরিবর্তিত হয়েছে। গবেষকরা আশঙ্কা করেছেন যে হারে পদ্মা নদী পরিবর্তিত হচ্ছে তা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ইলিশ উৎপাদনের উপর ব্যাপকহারে প্রভাব ফেলবে। আর এ কারণে গবেষকরাও নতুন করে পদ্মা নদী থেকে শুরু থেকে ইলিশ ঊৎপাদনের সাথে জড়িত নদীগুলোকে বাঁচানোর তাগিদ দিয়েছেন।

গবেষকদলের প্রধান বাকৃবি এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা মূলত সর্পিল নদী, একেঁবেঁকে চলাই এর প্রধান কাজ। কিন্তু আবহাওয়া এবং নদীর ক্ষয় ও পলি জমার কারণে এটি অনেকটা চুলের বিনুনির আকার ধারণ করেছে, অর্থাৎ অনেক শাখানদী সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে জোয়ারের উচ্চতা থাকে বেশি। একই সঙ্গে উজান থেকে নিচের দিকে পানির প্রবাহও বেশি থাকে। সামনের দিনগুলোয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি, বন্যার পানির তীব্রতা ও উচ্চ তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে উজানের পানিপ্রবাহেও পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে পলি জমা ও পাড় ক্ষয়ের কারণে বন্যার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

এই গবেষক আরো বলেন, আমরা এ নদীকে ঘিরে মানুষের জীবনযাত্রার নানা বৈশিষ্ট্যও খুঁজে দেখেছি। একই সঙ্গে এ নদীর অন্যতম প্রধান মাছ ইলিশের আবাসস্থল ও এ মাছকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার স্বরূপও বিশ্লেষণ করেছি। এজন্য আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে গত ৫০ বছরের বিভিন্ন তথ্য ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করেছি। আমরা গবেষণায়, জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এ নদীর আচরণগত পরিবর্তনও দেখে অবাক হয়েছি। আগে দেখা যেত যারা এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা ভাঙনের ফলে শহরে এসে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন।

আবার দখল ও দূষণের ফলে নদীর আচরণগত পরিবর্তনও হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে মাছ আহরণের পরিমাণের ওপর। বিশেষ করে এ নদীতে ইলিশ আহরণের পরিমাণ যে হারে বাড়ার কথা ছিল, সে হারে বাড়েনি। দেশের অন্যতম নদী মেঘনা, যমুনাসহ ইলিশ উৎপাদনে জড়িত অন্য নদীগুলোও নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছি যাতে করে ইলিশ উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণগুলো জানা সম্ভব হবো। আর  এ গবেষণার তথ্যগুলো ব্যবহার করে সরকার ও ইলিশ উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে পারবে বলে আশা রাখছি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 + one =

Back to top button