প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্সে সৌদিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র
দেশের স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে যে দেশ থেকে, সেই সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছ’মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশটিতে বসবাসকারী প্রবাসীরা ১৯৬ কোটি ৬৭ লাখ (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। আর সৌদি আরব থেকে এসেছে ১৯০ কোটি ৯১ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার।
এ ছয় মাসের চার মাসেই সৌদির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। সবশেষ ডিসেম্বর মাসে ব্যবধান সবচেয়ে বেশি। এ মাসে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৩০ কোটি ৬৪ লাখ ডলার আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৪২ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সৌদি আরবের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ছয় মাসের হিসাবে আমেরিকা থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স দেশে এলো। আর এর ওপর ভর করেই রেমিট্যান্স-প্রবাহে ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদশ। অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) গত বছরের একই সময়ের চেয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমেরিকা থেকে প্রবাসীরা দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠান, তার পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠান। ওই দেশ থেকে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। অথচ বরাবরই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
‘ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় সম্প্রতি তা আরও বেড়ে গেছে। সে কারণেই সৌদি থেকে রেমিট্যান্স কমছে আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়ছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৪৯ কোটি ৩২ লাখ (১০.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
অথচ সৌদি আরব থেকে এ ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এসেছিল ২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে এসেছে ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অবশ্য রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দেশটি থেকে ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৪ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৮১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
যুক্তরাজ্য থেকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৯১ কোটি ১১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৮৮ কোটি ডলার, বেড়েছে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। প্রতিবছর দেশে যে রেমিট্যান্স আসে, তার প্রায় অর্ধেক পাঠান সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। স্বাধীনতার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন সৌদি আরবে থাকা বাংলাদেশিরা। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
২০২০-২১ অর্থবছরে আরব আমিরাতকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে যুক্তরাষ্ট্র। ওই অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার, আরব আমিরাত থেকে আসে ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। আর যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ২৬ শতাংশ কমে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়নে নেমে আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় সমান ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা।
গত অর্থবছরে আরব আমিরাত থেকে ২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন এবং যুক্তরাজ্য থেকে ২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর পরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে; কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।
২০১২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসত কুয়েত থেকে। একক দেশ হিসেবে কুয়েত থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ এখন ষষ্ঠ অবস্থানে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা সব মিলিয়ে ১২ লাখের মতো হবে। এর মধ্যে নিউ ইয়র্কেই থাকেন প্রায় চার লাখ। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকায় বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির বসবাস।
কঠিন এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স কেন বাড়ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীরা যে টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন, তার প্রায় পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসছে। আর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অনেকে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। সে কারণে এই দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স অনেক কমে গেছে।’
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে। নানা পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তারা। অনেকের উপার্জনও ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকে টাকা রাখলে মুনাফা পাওয়া যায় না, কিন্তু দেশে টাকা পাঠিয়ে প্রবাসী বন্ড কিনলে ১০-১২ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়।
‘আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা এবং বন্ড কিনে মুনাফার আশায় এখন ইউএসএ থেকে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর এখন ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ১০৭ টাকা পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাওয়া যায় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে যার নামে পাঠান তিনি ১১৩ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন। এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে।’
‘আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে দেশে টাকা আসছে ঠিকই, কিন্তু ডলার আসছে না। আর এই ডলারই বিভিন্ন দেশে নানা প্রক্রিয়ায় চলে যাচ্ছে, যেটাকে অর্থ পাচার বলা হয়ে থাকে। হুন্ডিই এখন দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এটা খুব বেড়ে গেছে।’
অর্থ পাচার রোধ করতে হুন্ডি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা বেসরকারি ব্র্যাক ব্রাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ লোককে কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছি। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬ লাখের কিছু বেশি, কিন্তু দুঃখজনক হলো জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে হুন্ডি। ‘করোনা মহামারির কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অবৈধ হুন্ডি কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল, কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই ফের হুন্ডি কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি তা আরও বেড়ে গেছে।’
হুন্ডি বন্ধে প্রণোদনার পরিমাণ আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার পরামর্শ দিয়েছেন আবুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রবাসী ভাই-বোনদের কোনো দোষ দেখি না। তারা প্রতি ডলারে দুই-তিন টাকা বেশি পাচ্ছেন বলেই ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হুন্ডি বন্ধে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না; হুন্ডি বন্ধ হচ্ছে না।
‘ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধ পথে টাকা পাঠালে সরকার এখন আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কেউ ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা ৫০ পয়সা যোগ হয়ে ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন। সরকার যদি প্রণোদনার পরিমাণ ৫ শতাংশ করে দেয়, তাহলে তারা ১০০ টাকা পাঠালে ১০৫ পাবেন। এটি করলে সব প্রবাসী বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন বলেন আমি মনে করি।
‘এখানে প্রবাসীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা যেখানে বেশি টাকা পাওয়া যাবে, সেখানে যাবেন। প্রণোদনা ৫ শতাংশ করলে যখন তারা দেখবে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে যে টাকা পাওয়া যায়, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালেও সেই একই টাকা পাওয়া যায়, তখন তারা আর ঝুঁকি নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন না। বর্তমান কঠিন সময়ে রিজার্ভ বাড়াতে এই কাজটি সরকারের দ্রুত করা উচিত বলে আমি মনে করি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসীদের হুন্ডির বদলে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বুধবার প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতারা সরকারপ্রধানের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গেলে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রবাসীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা অনুরোধ করব আপনাদের, যে রেমিট্যান্স আপনারা পাঠান, সেটা হুন্ডিতে না পাঠিয়ে সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাবেন। এতে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে; অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে।’