BreakingLead Newsআন্তর্জাতিকরাজনীতিসরকার

নির্বাচন নিয়ে ইইউর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সরকার ও ইসি

মাঠপর্যায়ে নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে তা অংশগ্রহণমূলক হওয়ার পরিবেশ আছে কিনা তা মূল্যায়নে জুলাইয়ে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। সে সময় সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তাদের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।

সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তারা। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিভিন্ন মহল মনে করে, কোন কোন দল অংশ নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে সে ব্যাপারে ইইউ বা প্রভাবশালী দেশগুলো প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দুটি দল অংশ নিলেই শুধু সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা হয়ে থাকে। এর কোনো একটি দল ভোটে অংশ না নিলে সেটা একতরফা নির্বাচন হিসাবেই গণ্য হয়।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলো। ভোটে সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চান তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এ নিয়ে ইসির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আহ্বান জানানোর পাশাপাশি নানামুখী চাপও দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপের ২৭ রাষ্ট্রের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই শুধু পর্যবেক্ষক পাঠাবে ইইউ।

ফিরে গিয়ে ইইউর হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেফ বোরেলের কাছে তাদের মতামতসহ মূল্যায়ন রিপোর্ট জমা দেবেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই বাংলাদেশে নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেবেন জোসেফ বোরেল। তিনি ইতোমধ্যে বলেছেন, তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাতে প্রস্তুত। তবে পর্যবেক্ষক তখনই পাঠানো হবে যখন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালে একতরফা ভোট বিশ্বের কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও ভোটের নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলেও বিরোধী শিবির অভিযোগ করে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে ইইউ একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠায়। তাদের রিপোর্ট ইতিবাচক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক মিশন পাঠায়নি। ২০১৪ সালেও তারা আসেনি।

তারা মনে করেন, ফের একতরফা নির্বাচন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সম্পর্কে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠালে ভোট নিয়ে বিশ্বে একটা নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে। কারণ ওই দেশগুলো সম্পর্ক জোরদারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

দেশের রাজনৈতিক দল ও মানুষকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিদেশিরা নির্বাচন নিয়ে কি ভাবছে সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। কারণ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, আগামী নির্বাচন দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব শ্রেণি-পেশার মানুষসহ বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোরও প্রত্যাশা সব দলের অংশগ্রহণের পাশাপাশি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশা দেখছি না। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই। বড় দুদলের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ছে। আলোচনাকে তারা না বলে দিয়েছে। মাঠের নির্র্বাচনি পরিবেশও সমতল নয়। সংকট সমাধান না হলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেই মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত না হলে ইইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছে। কিন্তু একবার নির্বাচন হয়ে গেলে তারা আর কি করবে। অনেক কিছু করতে পারে, কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু কেন কার জন্য তারা কিছু করবে। এ নিয়ে হয়তো বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কথা বলবে। তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে দেশের মানুষকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্টদের ওপর প্রয়োজনে তারা চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্পষ্ট করে বলেছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। তারা যদি না আসে তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচন বৈধতার যে বিষয়টি থাকে সে ক্ষেত্রে একটি ঘাটতির আশঙ্কা থাকছে। যেটা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি। দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের জায়গাটা আগামী সরকারকেই অতিক্রম করতে হবে।

সে ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা অপরিহার্য। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা পেতে হলে মানবাধিকার ও সুশাসনের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসনের জায়গায় যাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক চর্চাকে শক্তিশালী করা। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা পেতে হলে একটি গ্রহণযোগ্যতার জায়গা তৈরি করতে হবে। অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে গ্রহণযোগ্যতার সেই জায়গাটি তৈরি হবে না।

তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনটা সুষ্ঠু হওয়া শুধু নির্বাচনের খাতিরে প্রয়োজন তা নয়, আগামীতে দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের যে চ্যালেঞ্জ আসবে তা মোকাবিলায়ও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে যাতে সবার কাছে নির্বাচনটা বৈধতা পায়। সে কারণে আমি মনে করি ইইউর বক্তব্যটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা উচিত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে নানামুখী চাপ থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।

ভোট নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে সরকার জোরালো প্রতিশ্রুতি দিলেও সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তারা অনেকটাই নীরব। বিশেষ করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোনো পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানে তেমন আগ্রহ নেই। উলটো সংকট সমাধানে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে দলটি।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, আমারও চাই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। সে লক্ষ্যে আমাদের সহযোগিতা থাকবে।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না ইইউ’র এমন মন্তব্যের উত্তরে তিনি বলেন, এটা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা।

অন্যদিকে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংলাপের আহ্বান জানানো ছাড়া দৃশ্যত আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি কমিশন। তাদের প্রতি এখনও সবার আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়নি। কমিশন মনে করে, বিদ্যমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাচন সুষ্ঠু করা ইসির দায়িত্ব। সব দল অংশ না নিলে সেক্ষেত্রে ইসি আইনগত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের যে দাবি জানিয়ে আসছে, ওই দাবি নিয়ে আলোচনা করা বা অন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।

নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় নির্বাচন আয়োজনে যে ১৪টি চ্যালেঞ্জ এবং চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১৯টি উপায় উল্লেখ করেছে, সেখানেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে ইসি কিছু উল্লেখ করেনি। তবে সরকার ও ইসির ওপর আস্থা সৃষ্টির বিষয়টি ইসির চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবেন। ওই আবেদন আমরা পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এনওসি নিয়ে থাকি। এই প্রক্রিয়ায় যে কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক ও বিদেশি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের আগাম একটি বিশেষজ্ঞ দল এ দেশে আসার বিষয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা ওই প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন তাদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। সেখানে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা আছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে। বিএনপিসহ যেসব দল সংলাপে অংশ নেয়নি তাদের দ্বিতীয় ধাপে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওই আমন্ত্রণে কোনো দলই সাড়া দেয়নি।

আবার এসব দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে কিনা সে বিষয়ে কমিশন এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সব দল নির্বাচনে অংশ নিক সেই উদ্যোগ কমিশনের সব সময় রয়েছে। তবে কোনো দলকে ধরে-বেঁধে নির্বাচনে আনতে কমিশন উদ্যোগ নেবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − two =

Back to top button