Breakingদেশবাংলা

খালে নেমে মই দিয়ে উঠতে হয় দেড় কোটি টাকার সেতুতে

প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে সদ্য নির্মিত পাশাপাশি দুটি সেতু কাজে আসছে না স্থানীয়দের। প্রতিদিন দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করছেন হাজারো মানুষ। এর মধ্যে একটি সেতুর একপাশে দেওয়া সামান্য মাটি পুরোপুরি সরে গিয়ে খাদের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে স্থানীয়রা এখন সেতুতে উঠছেন কাঠের মই দিয়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিকল্পনায় ত্রুটি ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় তাদের দীর্ঘদিনের ‘স্বপ্নের সেতু’ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আওতায় সেতুটি পাইলিংয়ের বদলে ‘বেজ ঢালাই’সহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে নির্মাণ শেষ করে বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে দুটি সেতুর উভয় পাশেই মাটির অ্যাপ্রোচ রোড (সংযোগ সড়ক) তৈরি করেনি সংশ্লিষ্টরা। নির্মাণকাজ চলাকালে এ বিষয়ে দাবি তুললেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার- প্রকৌশলীরা তা আমলে নেননি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বৈরাতী গ্রামের হাজিরহাট এলাকার একটি খালে দুটি সেতু তৈরি করা হয়েছে। উত্তর-দক্ষিণের সেতুটি ‘রংপুর অঞ্চলের উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন ও সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় বড় আকারের হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার-ফুট ব্রিজ’ নির্মাণ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)।

৭৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকায় ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি নির্মাণকাজ পায় নেত্রকোণার ‘এ টি এল এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাজ পেয়ে ওই ঠিকাদার স্থানীয় আওয়ামী লীগ এক নেতার কাছে কাজটি বিক্রি করে দেন। অপর দিকে ওই খালের পূর্ব-পশ্চিম দিকের ১৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটির জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে অর্থায়ন করে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা)। এর ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭০ লাখ টাকা। টেন্ডারের মাধ্যমে এটি নির্মাণের কাজ পায় আদিতমারীর মো. ইব্রাহিম নামের একজন ঠিকাদার। সেটিও স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে বিক্রি করেন। যার ফলে দেড় কোটি টাকার সেতুটির ৫০ লাখ টাকার কাজও হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

সরেজমিন দেখা যায়, খালের তুলনায় দুটি সেতু হয়েছে আকারে ছোট, খালের মাঝামাঝিতে শেষ হয়ে যায়। ফলে লোকজনকে অনেকটা খালে নেমে এরপর সেতুতে উঠে পারাপার হতে হয়। বৃষ্টি বা বন্যার পানি হলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ‘ত্রাণের ব্রিজ’ হিসেবে পরিচিত সেতুর পূর্ব পাশে করা হয়নি সংযোগ সড়কের কাজ। সেখানে সামান্য যা মাটি ছিল তা ভেসে গিয়ে খাদের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্থানীয় লোকজন নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ-কাঠ দিয়ে মই আকৃতির সিঁড়ি বানিয়ে অনেক কষ্ট করে সেই সেতুতে উঠছে। তবে সেখান দিয়ে কোনো ধরনের যানবাহন পারাপারের সুযোগ নেই। সেতুর পশ্চিম প্রান্তের মাটিও কিছুটা সরে গেছে। অপরদিকে বিএডিসি নির্মিত সেতুরও প্রায় একই হাল। দুই পাশের অনেক জায়গার মাটি সরে গেছে, লোকজন পারাপার করছেন খাল-পানি মাড়িয়ে। আবার সমন্বয়হীনতার কারণে পানি প্রবাহেও বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুই কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা, ভুল পরিকল্পনা ও আকারে ছোট হওয়ায় দেড় কোটি টাকার সেতু দুটি এখন তাদের কাজে আসছে না। তাদের অভিযোগ, দুটি সেতু নির্মাণে অনিয়ম করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘ত্রাণের ব্রিজ’ পাইলিংয়ের মাধ্যমে করার কথা থাকলেও সেটি না করে পিআইও’র সঙ্গে যোগসাজশে বেজ ঢালাইয়ের মাধ্যমে কাজ করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ঠিকাদার।

সাম্প্রতিক বন্যার পর পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সমাজ কল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জমান আহমেদও সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে ব্রিজটি করা হলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এ বিষয়ে এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলে ব্রিজ দুটি যাতে স্থায়ীভাবে তৈরি করে মানুষের যাতে আর কোনো ধরনের দুর্ভোগের সৃষ্টি না হয় সেজন্য ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।

ওই এলাকার আজিজসহ অনেকেই বলেন, ব্রিজের ওপরেই আমগোর বাড়ি। আমরা বারবার বলছিলাম যে, আপনারা ব্রিজটা যে এইভাক কইরা দিতাছেন আমরাতো হাঁটতেই পারমু না। আমাদের বাড়িও এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, বড় বন্যা আসলেই ব্রিজের কারণে আমাদের বাড়িঘর ভাইংগা যাইবো। এখন পোলাপান স্কুলে যাইকে পারে না, হাটবাজার যাওয়া যায় না।

আব্বাস আলী নামের আরেকজন বলেন, ‘ব্রিজের এখানো কোনো রাস্তা করে নাই। তারা বলছিল ব্রিজ যখন কমপ্লিট হবে তখন এখান দিয়া রাস্তা বাইন্দা দিয়া যাব কিন্তু তারা ব্রিজটা কইরা চইলা গেছে। এজন্য ব্রিজ হয়াও আমাদের কষ্ট, এখন মই লাগায়া চলাচল করছি।’
বৃদ্ধ এন্তাজ আলী বলেন, ‘দুই দুইটা ব্রিজ হইছি ঠিকই কিন্তু আমরা চড়তে পারছি না’।

আব্দুল লতিফ নামের অপর একজন বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবিরে পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিজ হয়েছে কিন্তু এখান দিয়ে সাধারণ মানুষ গাড়িঘোড়া দূরের কথা হেঁটে চলাচল করতেই দুর্ভোগে পড়েছে।’

তাদের অভিযোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ব্রিজের পাইলিংয়ের জন্য কোনো মেশিনপত্র সেখানে আনা হয়নি বা পাইলিং করা হয়নি। বেজ ঢালাইয়ের মাধ্যমে সেটি তৈরি করা হয়েছে।

সেতু নির্মাণে পরিকল্পনা ত্রুটির কথা অস্বীকার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু নির্মাণে তদারকিতে থাকা কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফেরদৌস আহমেদ বলেন, সমীক্ষা শেষেই সেতুটি করা হয়েছে। ঠিকাদার অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ করে দেবে।

অপরদিকে লালমনিরহাট বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন সেতু তৈরিতে অনিয়ম হয়নি দাবি করে সাংবাদিকদের বলেন, তাদের সর্ব্বোচ্চ বরাদ্দ সেতুর দৈর্ঘ্য ৩০ মিটার ফলে পুরো খালজুড়ে তা করা সম্ভব হয়নি। তবে সড়ক নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 2 =

Back to top button