Lead Newsইতিহাসের ডায়েরীজাতীয়

মেজর ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণ করা সেই ব্যক্তির কী হয়েছিলো?

শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পেছনে যে কটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণের ঘটনাও একটি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বলে মনে করেন অনেকে। ১৯৭৪ সালে গাজী গোলাম মোস্তফা মেজর শরিফুল হক ডালিম ও তার স্ত্রীকে ঢাকা লেডিজ ক্লাব থেকে অপহরণ করে। মেজর ডালিমের আত্মীয় তাহমিনার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছিল কর্নেল রেজার। সেখানে এই ঘটনা ঘটে বলেও মনে করা হয়।

এহেন বিতর্কের বিষয়ে অন্তত ২টি সংস্করণ চালু আছে উইকিপিডিয়ায়। একটিতে বলা হয়, মোস্তফার ভাই ডালিমের স্ত্রী নিম্মির প্রতি অশালীন মন্তব্য করায় বাক-বিতন্ডার সূত্রপাত হয়। এতে মোস্তফার দুই ছেলেও জড়িয়ে পড়েন। আর আরেকটি সংস্করনে শোনা যায় সরাসরি মেজর ডালিমের মুখে।

গত রোববার রাতে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের লাইভ টকশোতে দীর্ঘদিন আড়ালে থাকা মেজর ডালিম কথা বলেছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। লাইভে ৫০ বছরের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিদেশে নির্বাসিত আলোচিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। এই লাইভে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণের ঘটনা নিয়েও কথা বলেন তিনি।

জবাবে মেজর ডালিম বলেন, “এটা একটা মজার ঘটনা। আমি আমার বইতে এটির কথা উল্লেখ করেছি। আমার এক খালাতো বোন পারভিনার বিয়ের আয়োজন আমি এবং নিম্নি, কর্নেল অলিউল্লা করেছিলাম। বিয়ে ও অনুষ্ঠান লেডিস ক্লাবে হবে। দুপক্ষই আমাদের পরিচিত ছিলো। সব আয়োজন আমাদের ওপর ছিল। এই আয়োজনের মধ্যে ২-৩ হাজার লোককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিয়ের আসর চলছিল, তখন আমার একমাত্র শালা বাপ্পি, যিনি ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন, সে অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিল। আমি ও নিম্নি দুই পক্ষের হোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম।”

তিনি বলেন, “বাপ্পি ছেলেদের বসার জায়গায় বসেছিল, তখন কিছু ছেলে তার চুল টানতে থাকে। প্রথমবারে বাপ্পি কিছু বলেনি, কিন্তু পরেরবার টানার পর সে পেছনে তাকিয়ে দেখে একজন ছেলে। তারপর সে বলেছিল, ‘তুমি চুল টানছো?’ তখন ওই ছেলে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমরা দেখছিলাম, তোমার চুল এত সুন্দর, এটি কি পরচুলা না আসল?’ বাপ্পি বলেছিল, ‘বেয়াদব ছেলে, তুমি আর এখানে বসবে না।’ এরপর ছেলেগুলো চলে যায়।”

তারপর সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। কিছুক্ষণ পর রেডক্রসের দুটি মাইক্রোবাস ও একটি গাড়ি এসে থামে এবং সাদা পোশাকধারী লোকেরা নামতে থাকে। গাজী গোলাম মোস্তফা, যিনি তখন আওয়ামী লীগ নেতা এবং রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন, গাড়ি থেকে বেরিয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন, “মেজর ডালিম কোথায়? কোথায় মেজর ডালিম?” এরপর তার সাথে ৮-১০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি উপস্থিত হলো।

তারা আরও কয়েকজনসহ মেজর ডালিম তার স্ত্রী নিম্মি, কর্নেল রেজার মা এবং ডালিমের আরও ২ জন বন্ধুকে উঠিয়ে একটি রেড ক্রিসেন্টের মাইক্রবাসে করে অপহরণ করেন।

এরপর সারা শহরে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট বসানো হয়। প্রতিটা গাড়িতে তল্লাশী চালানো হয় ডালিমদের উদ্ধারের। শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধানকে ডাকিয়ে, তার সামনে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা মধ্যস্থতা করেন এবং মোস্তফাকে নিম্মির কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ গাজী গোলাম মোস্তফা পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। একই সাথে মোস্তফা ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, রেডক্রস বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সিটি ইউনিটের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে পাঠানো লাখ লাখ কম্বল ও শিশু খাদ্যের টিন আত্মসাৎ করেছিলেন। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিবের জন্য পাঠানো কম্বলও আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।

উইকিপিডিয়া থেকে আরও জানা যায়, মোস্তফার দুই ছেলে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ৭৫ এর আগষ্টে শেখ মুজিবের প্রশাসনের পতনের পর মোস্তফা বিপুল অর্থসহ স্থল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করার সময় পথচারীদের হাতে ধরা পড়ে। তখন তাকে জেলে পাঠানো হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মোস্তফা কারাগারে বন্দী ছিলেন। সামরিক আইন আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন এবং ১৯৮০ সালের ২৮ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

পরে গাজী গোলাম মোস্তফা আজমিরে মুইন আল-দীন চিশতির মাজার পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তার পরিবার নিয়ে ভারত গিয়েছিলেন এবং কিছু দিন দিল্লিতে ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি গাড়িতে করে আজমীর যাওয়ার পথে একটি ট্রাকের সঙ্গে তাদের গাড়ির সংঘর্ষ হলে মোস্তফা এবং তার পুরো পরিবার মারা যায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven + 4 =

Back to top button