জাতীয়

খুন ও গুজবের বছর ২০১৯, শুদ্ধি অভিযানে স্বস্তি

২০১৯ সাল পুলিশের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জের একটি বছর। যত না অর্জন ছিল; অভিযোগ বা মাদকের সাথে পুলিশের সংশ্লিষ্টতারও কমতি ছিল না। তবে বছরটিতে বিনা পয়সায় কনস্টেবল নিয়োগ পুলিশ বিভাগের দীর্ঘদিনের কালিমা কিছুটা হলেও লেপন করেছে। ছোটখাট অপরাধের দ্রুত সমাধান দেওয়ায় পুলিশের ৯৯৯ হেল্প লাইন নম্বরটিও ছিল বেশ আলোচিত।

বছরটিতে জঙ্গি তৎপরতা তেমন একটা লক্ষ করা যায়নি। পরিস্থিতি একেবারেই ছিল পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। মাদক নির্মূলে এ বছরটিতে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এ নিহত হয় ৪৭৪ মাদক কারবারি। যদিও এতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি মাদক কেনাবেচা।

বছরের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছিল বুয়েটে আবরার হত্যা। বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা এবং ফেনীর নুসরাত হত্যাও ছিল আলোচিত। গুলশানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীসহ কয়েকজন সড়ক দুর্ঘটনার জেরে হতাহত হয়। এর জেরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বেশ সাড়া ফেলেছিল।

তবে বছরের শেষের দিকে সরকারের শুদ্ধি অভিযান সর্বমহলেই প্রশংসিত হয়। হঠাৎ শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান বা শুদ্ধি অভিযান নিয়ে যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক খান চৌধুরীসহ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

বিদায়ী বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢাকার মহানগর আদালতে বেশ কিছু আলোচিত মামলার রায় হয়। যে রায়ে সাজা থেকে রেহাই পাননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের এক সংসদ সদস্যের ছেলে রনিসহ ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম। আর রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় জাবালে নূর বাসের চালক-হেলপারসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিগত বছরের আলোচিত অপরাধ, হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতনে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা, মাদক নির্মূলে ক্রসফায়ার, জরুরি সেবা ৯৯৯, ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান আলোচিত সাজা নিয়ে দৈনিক অধিকারের এবারের আয়োজন
ফিরে দেখা২০১৯

বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা

বছরের ৬ অক্টোবর দিনগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ির নিচ থেকে উদ্ধার হয় আবরার ফাহাদ (২১) নামের এক ছাত্রের লাশ। ঘটনায় জানা গেল, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আবরারকে ভারতবিরোধী একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে। আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে সহপাঠীরা। এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পুলিশ খুনিদের গ্রেফতারও করে। ছাত্রদের জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। বহিষ্কার করা হয় খুনের সঙ্গে জড়িত ২৫ জনকে।

আলোচিত বরগুনার রিফাত হত্যা

২৬ জুন সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য। সেখানে দেখা যায়, কিছু তরুণ আরেক তরুণকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছেন। আর সেই তরুণকে প্রাণপনে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন এক তরুণী। হতভাগা ওই তরুণের নাম রিফাত শরীফ আর ওই তরুণী ছিল তার স্ত্রী মিন্নি। আর রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করেন মিন্নির কথিত প্রেমিক নয়ন বন্ড। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে, এই তরুণকে যারা খুন করেছেন, তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় সাংসদের ছেলে। যদিও রাজনৈতিক চাপে তদন্তের মাঝপথে পুলিশ নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নিকেও গ্রেফতার করে। তদন্ত শেষে ২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। রিফাতের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়। পরে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পান।

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী রাফি হত্যা

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার লালসার শিকার হয়ে সোনাগাজী থানার অফিসার ইনচার্জের দ্বারস্থ হয়েছিলেন মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। তবে ওসি মামলা নিলেও অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। আর একই ঘটনায় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা মামলা তুলে নিতে রাফিকে চাপ দেন। রাফি রাজি না হওয়ায় ৬ এপ্রিল তার হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় বোরকা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। ১০ এপ্রিল বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত। ২৪ অক্টোবর এ ঘটনায় ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় এবং এ মামলায় তার আট বছরের সাজা হয়েছে।

গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেণু হত্যা

ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির শিকার হয়ে নির্মমভাবে মৃত্যু হয় তাসলিমা বেগম রেণুর। ২০ জুলাই সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে যান রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন রেণু। পরে পিটিয়ে মারার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। রেণু পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ভিড় করে মানুষ দেখছিলেন এবং অনেকে ভিডিও করছিলেন সেই দৃশ্য কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাননি।

জঙ্গি পরিস্থিতিতে পুলিশের সাফল্য

২০১৮ সালে দেশে জঙ্গি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও ২০১৯ সালে জঙ্গি পরিস্থিতি পুরোটাই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

মাদক নির্মূলে ক্রসফায়ারই ভরসা

মাদক নির্মূলে ‘ক্রসফায়ার’ই ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভরসা। মাদকের বিস্তার রোধে বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী অভিযান শুরু হয়। মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে ৪৭৪ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। এদের মধ্যে শুধু কক্সবাজারেই নিহত হন ৩ নারীসহ ১৯২ জন। এই ১৯২ জনের ২ নারীসহ ৪৯ জন রোহিঙ্গা। এ সময় ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন।

পুলিশের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ 

শহর কিংবা গ্রামাঞ্চল—সবজায়গাতেই নারীর নিরাপত্তাহীনতা যেন বেড়ে গিয়েছিল। তবে নারী নির্যাতনের সাথে পুলিশের কিছু সদস্যের সংশ্লিষ্টতা বেশ সমালোচিত হয়েছিল।

বছরের একদম শুরুতেই ২৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় ইসলামী জলশা শুনতে আসা এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে পুলিশের কনস্টেবল। চাকরি ও বিয়ের প্রলোভন দিয়ে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহমুদুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।

খুলনা রেলওয়ে থানার (জিআরপি) ভেতর এক নারীকে আটকে রেখে রাতভর ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে। ১৯ আগস্টের এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় আটক করা হয় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে।

যশোরের শার্শায় পুলিশের এসআইসহ চারজনের বিরুদ্ধে এক নারীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

পয়সা ছাড়া পুলিশে নিয়োগ

এ বছর পুলিশ বাহিনীতে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ছিল না। অথচ আগে এই নিয়োগেই ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে লেনদেনের কথা শোনা গেছে। যা পুলিশ বাহিনীর নিয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি সাফল্য।

ভরসা ৯৯৯

সর্বমহলে চমক দেখিয়েছে জাতীয় জরুরি সেবা হেল্প লাইন ৯৯৯। অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের কল পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়েছে এই সেবা। দুর্ঘটনায় সহায়তা, বাল্যবিবাহ রোধ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার, গৃহকর্মী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদিতে ৯৯৯ প্রশংসিত হয়েছে। ঝামেলা এড়িয়ে সহজেই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা পাচ্ছে মানুষ।

আলোচিত শুদ্ধি অভিযান

১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘ক্যাসিনো’ শব্দটির সাথে হঠাৎই পরিচিত হয় বাংলাদেশের মানুষ। উন্নত দেশগুলোর মতো রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে জুয়া খেলার আধুনিক ও পাকাপাকি ব্যবস্থা রয়েছে। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযান চালানো হয় আরও চারটি ক্যাসিনো ক্লাবে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের কয়েক দিন পর শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বন্যপ্রাণী ও মাদক মামলা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও অবৈধ অর্থের অনুসন্ধানে নেমেছে। তারা ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং ৩৪ জনের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে ৩১ অক্টোবরের পরে আর কোনো অভিযান হয়নি।

এমপিপুত্র রনির যাবজ্জীবন সাজা

চার বছর আগে রাজধানীর মগবাজারের নিউ ইস্কাটনে গাড়ি থেকে হঠাৎ এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ হারান নিরপরাধ দুজন মানুষ। অনুসন্ধানে উঠে আসে, ঘটনাটি ঘটিয়েছেন মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি। তবে এমপিপুত্র হয়েও ছাড় পাননি তিনি, এসেছেন বিচারের আওতায়। ওই খুনের ঘটনায় এমপিপুত্র রনিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওসি মোয়াজ্জেমই প্রথম

বিদায়ী বছরের শেষদিকে আট বছরের কারাদণ্ড হয় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের। শ্লীলতাহানির অভিযোগ দিতে থানায় গেলে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দি ভিডিও করে করে তা ছড়িয়ে দেন ইন্টারনেটে। এ ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গত ২৮ নভেম্বর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন দুটি ধারায় মোয়াজ্জেমকে মোট আট বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে দুটি ধারায় আরও ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন তাকে। ২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হচ্ছেন ওসি মোয়াজ্জেম।

দিয়ারাজীবের মৃত্যুতে চালকসহ তিনজনের সাজা

দুই চালকসহ তিনজনের যাবজ্জীবন বেপরোয়া দুই বাসের রেষারেষিতে রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিমের মৃত্যু ২০১৮ সালে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে। আলোচিত এ ঘটনায় হওয়া মামলায় রায় হয়েছে দেড় বছরের মধ্যেই। গত ১ ডিসেম্বর ওই রায়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ দুই বাসের চালকসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং এক বাসের সহকারী কাজী আসাদ, সূত্র অধিকার নিউজ।

 

আরও খবর পেতেঃ রাজনীতি এবং  কেমন ছিল ২০১৯ সাল

Tag: All online newspapers list,  Online newspapers list all, Online newspapers list bd, Online newspapers list all bd

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × one =

Back to top button