নগরজীবন

এবার শাহবাগে আন্দোলনরত মেয়েদের ধর্ষণের হুমকি

চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রীদেরকে ফোনে ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ফেসবুক স্ট্যাটাসে এমন একটি হুমকির স্ক্রিনশটও তুলে ধরেছেন একজন৷

মাহমুদা দীপা ছাত্র ইউনিয়নের লালবাগ শাখার শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য৷ অপূর্ব হোসাইন নামে একজন তাকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে লিখেছেন, ‘‘…তোরে যদি আর শাহবাগে দেখি মাইক হাতে স্লোগান দিতে তাহলে তুই আর বাসায় ফিরে যাইতে পারবি না৷ শাহবাগেই তোরে রেপ কইরা পুইতা ফালামু৷’’ ম্যাসেঞ্জারের এই বার্তার বেশিরভাগ লেখাই অপ্রকাশযোগ্য৷

মাহমুদা বার্তাটির স্ক্রিনশট দিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘‘আমি জানি না কে এই ভদ্রলোক, তবে এইভাবে ভয় দেখিয়ে আসলে কতদিন? সে আমাকে মেসেজ দিয়ে ব্লক করে দিয়েছে৷ ভয় দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না৷’’

এই বিষয়ে মাহমুদা দীপার সঙ্গে ডয়চে ভেলে থেকে যোগাযোগ করা হলে জানান, রোববার সকালে তার ম্যাসেঞ্জারে বার্তাটি এসেছে৷ অসুস্থতার কারণে তিনি এই বিষয়ে এখনও কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন নি৷ তবে দলীয় নেতাদের বিষয়টি জানিয়ে রেখেছেন৷ তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিবেন৷ শুধু তিনি নন, তার মতো আরো কয়েকজনও এমন হুমকি পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন মাহমুদা দীপা৷ এরমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদককেও বেনামে ফোন করে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি৷

এই বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সংগঠনের অনেক নেত্রীকে তো মোবাইল ফোনে এসএমএস দিয়ে বলা হচ্ছে, যদি আর একটি বারও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলো তাহলে শাহবাগে গণধর্ষণ করে পুতে ফেলা হবে৷ শুধু মুখে না, তারা প্রতিনিয়তই এভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে৷’’

পুলিশ সদরের বিবৃতিতে ক্ষোভ

এদিকে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে শনিবার বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারীরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না৷ কিন্তু বিবেকের তাড়নায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছি৷ যেভাবে ধর্ষণ বেড়ে গেছে, তাতে যেকোন সুস্থ মানুষ এর প্রতিবাদ করবেন৷ কিন্তু প্রতিবাদকারীদের হুমকি দিয়ে থামানো যায় না৷ আগেও যায়নি৷ বরং প্রতিবাদকারীদের হুমকি না দিয়ে, ধর্ষক ও তাদের সহযোগিদের গ্রেফতারের দিকেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি৷’’

ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে আন্দোলন থামানো যাবে না৷ আমরা দেখেছি, যেখানেই এই অপকর্মগুলো হচ্ছে সেখানেই কোন না কোনভাবে সরকারি দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে৷ সরকার এখন এসব অপকর্ম থামাতে না পেরে হুমকি-ধামকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে৷’’

‘প্রতিবাদ করা মানুষের অধিকার’

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ সদরের এই বিবৃতি একেবারেই অনাকাঙ্খিত৷ এটার কোন প্রয়োজন ছিল না৷ এই ধরনের ধর্ষণকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা প্রতিটি গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষের অধিকার৷ এখন এই আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে যদি কেউ ষড়যন্ত্র করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে৷ কিন্তু আগ বাড়িয়ে এই ধরনের হুঁশিয়ারি আমার কাছে মনে হয়, স্বাধীন মত প্রকাশের উপর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপের শামিল৷ এখন এই ধরনের হুঁশিয়ারির ফলে অনেকেই নিরাপত্তার কথা ভেবে আন্দোলনে যাবেন না৷ নিজের কষ্ট নিজের মধ্যে চেপে রাখবেন৷ অনেক সময় এই ধরনের হুমকি উস্কানি হিসেবেও কাজ করে৷’’

তবে এই বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সদর দপ্তর সতর্ক করে বিবৃতি দিতে পারে৷ এমনকি তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্যও থাকতে পারে৷ সারাবিশ্বেই দেখা যায় আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে বিরোধীপক্ষ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে৷ সরাসরি যদি বলি, এই ধরনের আন্দোলনের সময় কি বিএনপি বসে থাকবে? তারা তো কিছু না কিছু সুবিধা নেওয়া চেষ্টা করবে৷ আগেও এমনটা হয়েছে৷ এখন যারা আন্দোলন করছে তাদের তো কেউ বাধা দিচ্ছে না৷ আন্দোলন করা, প্রতিবাদ করা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার৷ কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে কেউ রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করলে সরকার বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তো ব্যবস্থা নেবে৷’’

পুলিশের আরেকজন সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকও মনে করেন এই আন্দোলন থেকে সরকার বিরোধী পক্ষ সুবিধা নিতে পারে৷ ‘‘আগেও দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে বিরোধী পক্ষ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ এ কারণেই হয়তো আগে থেকেই সতর্কবার্তা দিয়েছে৷’’ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘তবে এই ধরনের সতর্কবার্তা জরুরি ছিলো না৷ এটা পুলিশ সদর না দিলেও পারতো৷’’

পুলিশ সদর দপ্তর যা বলেছে

শনিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিকারে সরকার ও রাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ সদিচ্ছা সত্ত্বেও’ একটি ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তৎপরতা চালাচ্ছে৷ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ‘রাষ্ট্রবিরোধী যে কোনো কর্মকাণ্ড’ সতর্কভাবে পরিহারের আহ্বান জানানো হয়েছে৷ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি নিশ্চিত করতে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে পুলিশ৷ মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে বিচারের জন্য প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে৷ আদালতের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীরা যথোপযুক্ত শাস্তি পাবেন বলে আশা করে পুলিশ সদর দপ্তর৷

আন্দোলনকারীদের দাবিতে সাড়া দিয়ে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে সরকারের আইন সংশোধনের উদ্যোগের কথাও তুলে ধরা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ পর্যায়’ থেকে এ বিষয়ে ‘সার্বক্ষণিক নজরদারি’ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা সত্ত্বেও একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তৎপর রয়েছে৷

‘সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’

এদিকে রোববার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের সাড়া না পেয়ে বিএনপি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের উপর ভর করে সরকারের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে৷ আন্দোলনের নামে সহিংসতা ছড়ালে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিবে৷

তিনি বলেন, বিএনপি বারবার আন্দোলনের ডাক দিয়েও জনগণের সাড়া পায়নি৷ তাদের ডাকে মানুষের আস্থা নেই৷ মানুষের সাড়া না পেয়ে একবার কোটা আন্দোলন, অন্যবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উপর ভর করেছিল৷ এখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ওপর তারা ভর করেছে৷ ‘‘সরকার নারী নির্যাতনসহ যে কোনো অপরাধের কঠোর অবস্থানে রয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,’’ বলেন ওবায়দুল কাদের৷ (সূত্র: ডয়চে ভেলে)

আরও খবর পেতে দেখুনঃ করোনা ভাইরাস নিউজ ধর্ম ও জীবন

Bangla Tribune, Bangla Tribune, Bangla Tribune, Bangla Tribune

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × five =

Back to top button