গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে (জিকে) যাবার আগে জিকের ভিতরের কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। গিয়ে দেখলাম, ওখানে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষজ্ঞ, অন্যান্য প্রকল্প কর্মী নির্বিশেষে সবার সকাল শুরু হয় কৃষিকাজ দিয়ে। ডাক্তারদের মাঠে উপস্থিত থাকলেই হয়, কিন্তু আলস্যহেতু সেই উপস্থিতিটুকুও আমার ছিল না। একবার কাশেম ভাই একটা নোটিশ দিয়েছিলেন আমি কেন ভাদ্র মাসে পর পর তিনদিন কৃষিকাজে যাইনি। যা হোক, এইসব নোটিশের কাগজ পাতলা হলেও ভার এবং ধার ছিল; ব্যক্তিগত ফাইলে চলে যেত, প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে পারত।
যখন আমার পরিবারকে নিয়ে কেন্দ্রে থাকছি, তখন ভোরবেলা মাঝে মাঝে কন্যাকে কোলে নিয়ে কৃষিকাজের মাঠে যেতাম। একবার কৃষিকাজে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী ময়না পুকুর থেকে শালুক তুলেছিল, তাই চিবিয়েছিলাম। আমি খুবই অভিযোজনশীল প্রাণী সেটা বারবার টের পেয়েছি।
আউটডোরে গিয়ে দেখলাম রোগিদের কার্ড আছে, স্বাস্থ্যবীমার বইও আছে। সে আমলে মোট চার ক্যাটাগরির রোগি ছিল; ক গ্রুপের রোগিরা নিম্নবিত্ত – এদের জন্য বিনামুল্যে ঔষধ, খ গ্রুপ মধ্যবিত্ত – এরা ঔষধের ২৫ ভাগ দাম কন্ট্রিবিউট করবে, গ গ্রুপ হচ্ছে ধনী – এরা প্রকৃত মূল্যে ঔষধ ও অন্যান্য সেবা গ্রহণ করবে, আর অ গ্রুপ ছিল হত দরিদ্র – সম্পূর্ণ ফ্রি। আমার নিজেরও একটা কার্ড করতে হয়েছিল। যোগদানের দিন রুটিন মেডিকেল চেক আপ করতে হয়েছিল। এক্সরে ফিল্মে ফুসফুসের বিশেষ জায়গায় একটা শাদা ছায়া ছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেটার রিপোর্টে লিখেছিলেন – ফুসফুসের প্রদাহ ভাল হয়ে গিয়ে দাগ রেখে গেছে এরকম কোনো কিছু। ডা. খোকন ভাই রেডিওলজি বিভাগে কাজ করতেন। পরদিন জানলাম উনিই রিপোর্টটা লিখেছিলেন। আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘এখন আর ভয়ের কিছু নাই; হয়ত কখনো কিছু হয়েছিল।‘
সেই স্বাস্থ্যবীমা কার্ড কাজেও লাগত; হাইপারএসিডিটি হলে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের সিমেটিডিন বড়ি (ঔষধের জেনেরিক নাম লিখা হত আর জিকের রেনিটিডিন প্রোডাক্ট ছিল না) লিখিয়ে নিতাম কোনো সহকর্মীকে দিয়ে। মমতাজ আপা কিংবা যিনি ডিসপেন্স করছেন তিনি যেন সিমেটিডিন নয়, হীরের টুকরো তুলে দিচ্ছেন! কিন্তু র্যাশনাল ইউজ অব মেডিসিন নিশ্চিত করতে গিয়ে এন্ডোস্কোপি ছাড়া কাউকে সিমেটিডিন লেখা বারণ, বড়ি এন্টাসিড লিখতে হত। অন্যথায় রোগি যখন গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তেও কঠিন মনিটরিং এর ফাঁদে পড়ে বীমা বইসহ ফেরত চলে আসার সম্ভাবনা ছিল!
একদিন এক রোগি বা তার এটেন্ডেন্ট মহিলাকে হাসপাতালের সামনে দাঁড় করিয়ে কাশেম ভাই সবাইকে ডাকলেন। ভাবলাম কারো কোনো অসংগত ঔষধের ব্যবহার ধরা পড়েছে! না, তিনি মহিলার হাতে ধরা একটি রেডিওর মতো যন্ত্র দেখিয়ে বলছিলেন, ‘দেখো, এই মহিলার হাতে একটা মোবাইল ফোন! ইউনুস ভাইয়ের স্বপ্ন বাস্তব হল!’ বলা বাহুল্য তখনও পর্যন্ত কেন্দ্রের কারো হাতেই মোবাইল ফোন ছিল না!
যা বলছিলাম, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা না করে অনুমানের ভিত্তিতে কৃমি বা আমাশয়ের চিকিৎসা দিতেও অস্বস্তিতে থাকতাম। স্বাস্থ্যকর্মী আউটডোরে বসে ইতিহাস লিখে সাধারণ পরীক্ষা করে রেফার করার প্রয়োজন হলে ডাক্তারের কাছে পাঠায়। স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখতে পারে। কিন্তু ডাক্তার হয়েও এক্সরে না দেখে এন্টিবায়োটিক লিখতে ভয় পেতাম। বরং সে তুলনায় সাবসেন্টারে যাওয়া ভাল ছিল, স্বাধীনতা ছিল; যদিও সাবসেন্টারের রোগিদের স্বাস্থ্যবীমা কার্ডে লেখা প্রেসক্রিপশনও কেন্দ্রের যে কারো হাতেই চলে আসতে পারে। জরুন, পানিশাইল, শিমুলিয়া, মিরেরচানগাও আর সাটুরিয়া উপকেন্দ্রে যেতে হত আমাদেরকে। সেই উপকেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকত, ডাক্তার যেত সপ্তাহে দুই দিন। বর্ষাকালে শিমুলিয়া যেতে হত শ্যালো নৌকায়। এ ছাড়া বাকি সব জায়গাতেই মোটর সাইকেল ছিল বাহন। মোটর সাইকেলে না গেলে বাস, রিকসা, ভ্যান আর পায়ে হেঁটে যেতে হত। মিরেরচানগাও কেন্দ্রের গ্রামীণ আবহ ভাল লাগত, উপরি পাওনা হিসেবে মাসকালাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেতে পারতাম; তাই এই কেন্দ্রটি আমার পছন্দ ছিল।
উপকেন্দ্রগুলো আমাদের মূলধারার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সুযোগ সুবিধার দিক থেকে এত নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল যে, শিমুলিয়া উপকেন্দ্রে গিয়ে যদি আমি একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের আত্মবিশ্বাস নিয়ে মায়েদেরকে চিকিৎসা না দিতে পারতাম তাহলে অনেক রোগির ক্ষেত্রেই, হয়ত আর চিকিৎসাই হত না। কেননা নানা কারণে রেফার করলে অনেকেই আর পরবর্তী চিকিৎসা নিত না। এই উপকেন্দ্রের রোগিদেরকে আমরা আবার মূল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার করতাম। বিশেষজ্ঞগণ ধানমণ্ডির নগর হাসপাতাল থেকে (মাত্র শুরু হয়েছে তখন) সপ্তাহে দুদিন করে আসতেন – মেডিসিন (আনোয়ার স্যার), গাইনি ও প্রসূতিবিদ্যা (দেলোয়ার স্যার), শিশু (মোফাজ্জল স্যার, মেসবাহ স্যার), ডেন্টাল (হান্নান ভাই, হাবিব ভাই), রেডিওলজি ইত্যাদি বিভাগে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞরা এসে সপ্তাহে দুদিন কাজ করে যেতেন।
আনোয়ার স্যারের সাথে মাঝে মধ্যে বসতাম। রোগি হিসেবে রেফার হয়ে আসা গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে আনোয়ার স্যারও খুব সহজ সরলভাবে কাছে নিতেন। কিন্তু স্যার হয়ত ডাক্তার হিসেবে রোগিদের রোগের বিচিত্র উৎস খুঁজতে গিয়ে আর সহজ সরল থাকতেন না; স্যার এমন সব প্রৌঢ়কে ভিডিআরএল পরীক্ষা করাতে দিতেন যে আমি অবাক হয়ে যেতাম। দেলোয়ার স্যার হয়ত সার্জারীর দল ভারি করার জন্য বলতেন, ‘কি খবর? কাজ টাজ কিছু শিখতে হবে না নাকি?’ জেনারেল সার্জন ছিলেন কর্নেল আলী – উনি সাভার ক্যাম্পাসেই থাকতেন, ফৌজি আর বিলেতি কায়দাকানুন জানা ছিল তার ভালই, কিন্তু ততদিনে তার হাত কাঁপে, যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে তাঁর। স্যারের মুখে অপারেশন পরবর্তী রোগিদেরকে ‘ব্রথ’ খেতে বলতে শুনে তো প্রথম দিন হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ হাবীব ভাইয়ের কাছে কয়েক বছর আগেও দাঁতের সমস্যা নিয়ে দেখাতে গিয়েছিলাম। তারিক ভাই অর্থোপেডিকসের কেসগুলো দেখতেন। শাহজাহান ভাই আর স্বপন ভাই ছিলেন ২৪ ঘন্টার সার্জন – জেনারেল সার্জারি আর স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার যত জরুরী অপারেশন দরকার হত সব তাঁরা দুজনে মিলেই করতেন! আনোয়ার স্যারের অবর্তমানে মেডিসিনের কেসগুলোর মতামত নিতে হলে বা রেফার করতে হলে ইকবাল ভাইয়ের শরণ নিতাম। বিদেশি ডাক্তার কেউ কেউ আসতেন ভলান্টিয়ার হিসেবে, কেউবা আসতেন ট্রপিকাল মেডিসিন শিখতে। অস্ট্রেলিয়ার টমিকো আর সুইস এলবেন আমার সময়ে ছিলেন। এদের নিয়েও কিছু স্মৃতি আছে; পরে এক সময় বলব।
সন্ধ্যার অফিস ভাল লাগত। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি শেষে কিছুটা একাডেমিক পরিবেশ পাওয়া যেত। যে রাতে বিশেষজ্ঞরা সাভারে অবস্থান করতেন, সে রাতে বৈজ্ঞানিক আলোচনা সভা বা ক্লিনিক্যাল সেশন হতো। লাইব্রেরিতে তারিক ভাই এটা সেটা পড়তে দিতেন কিংবা বাংলায় অনুবাদ করতে দিতেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একলাম্পসিয়ার প্রটোকল ইত্যাদি বাংলায় তৈরি করেছিলাম। স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্লাস নিতাম মাঝে মধ্যে। লাইব্রেরিতে মেডিকেল বই-পুস্তকের পাশাপাশি সাহিত্যের বইও দুই একটা ছিল। আমার নিজের প্রথম কবিতার বইটি লাইব্রেরিতে রেখে এসেছিলাম। জানি না এখন তা আর আছে কিনা!
মাঝে মধ্যে জাফর ভাই আসতেন – পরিদর্শন কিংবা মিটিংয়ে। আমি আমার কৌশল অনুযায়ী দূরে থেকেই হাজার তিনেক টাকা বেতনের চাকরিটাকে সুরক্ষিত করে যাব, আর এক সময় তিন চার মাসের জন্য চলে যাব শ্রীপুর উপকেন্দ্রে, যেখানে প্রকল্পের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পদে পাঠানো হবে আমাকে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে ইতালির অর্থায়নে একটা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতি ব্যাচে জনা পঞ্চাশেক ছাত্রী ভর্তি হয়, একটি দুটি ছাত্রও থাকে। ওদেরকে গড়ে তুলতে হবে। শ্রীপুর মিশন শেষেই আমাকে (মোটর সাইকেল পরীক্ষা উত্তীর্ণ ও লাইসেন্স প্রাপ্তি সাপেক্ষে) ঢাকার নগর হাসপাতালে পাঠানো হবে।
শ্রীপুরে গিয়েছিলাম স্ত্রী ও কন্যা শাশ্বতীসহ। কন্যার বয়স তখন দেড় বছর। সে কথা যথাসময়ে বলব।
লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।
(ধারাবাহিক…)
আরও সংবাদ পড়ুনঃ খোলা জানালা – ইতিহাসের ডায়েরী
Gonoshasthaya Kendra, Gonoshasthaya Kendra, Gonoshasthaya Kendra,Gonoshasthaya Kendra