ইতিহাসের ডায়েরী

“শোন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প বলি”; নবম পর্ব

যতই দিন যাচ্ছে ততই শ্রীপুরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। দেখা হলেই সহকর্মীরা বলে, “ও আপনি তো শ্রীপুর যাচ্ছেন!”

শ্রীপুর হয়ত পরের সপ্তাহেই যাব। এমন সময় সপ্তাহান্তে ঢাকায় ছুটি কাটাতে এসে প্রবল জ্বরে পড়লাম। মাথায় পানি-টানি ঢেলে অস্থির অবস্থা। আমি তখন প্রশিক্ষণাধীন, আর ডা. তারিক ভাই যেহেতু প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী, তাঁকে ফোন করে জানানো হল। তিনি বললেন আগে সুস্থ হয়ে তারপর জিকে’তে ফিরতে।

জিকে’র টেলিফোনে সহজে কাউকে পাওয়া কঠিন ছিল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে লাইন পেয়ে কথা বলতে হত। আমার চট্টগ্রামের কবিবন্ধু পুলক পাল একদিন ফোন করেছিল নতুন সংখ্যা ‘লিরিক’ পত্রিকার জন্য লেখা চেয়ে; কয়েকবারের চেষ্টায় আমাকে ধরতে পেরেছিল, তাও কথা বলেছিলাম রিসেপসনের কোলাহলমুখরতায় দাঁড়িয়ে। মেয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ঠিকঠাক মতো টেলিফোনে বাসায় কথা বলতে না পেরে কফিল ভাই তো চাকরি ছেড়ে সাভারের রাবেয়া ক্লিনিকেই চলে গিয়েছিলেন!

জিকে’র টেলিফোন প্রসঙ্গে কবি সোহেল অমিতাভের ‘টেলিফোনে মিরপুর’ কবিতাটা মনে পড়ে। কবিতাটি আশির দশকের শেষের দিকে পড়েছিলাম। স্মৃতি থেকে বলছি- সেই কবিতায় কবি কখনোই মিরপুরে টেলিফোন করতে চান না, কেননা টেলিফোনের লাইনের ভিতরে অনেক জল, ঝড়-বাদলের শব্দ, ভয়ের কারণ ইত্যাদি, তাই ‘ভুল করে টেলিফোনে মিরপুরে নয়!’

“এক ঝাঁক কেচো আছে
টেলিফোন বাতিঘরে,
ঘুরে ঘুরে ঢুকে পড়ে অকারণ ভয়।
(টেলিফোনে মিরপুর, সোহেল অমিতাভ)

যাহোক জ্বর শেষে ফিরে এসে সিকরুমের রাউন্ডে গেছি। শাহজাহান ভাই মৃদু বকা দিলেন- ‘কই ছিলা তুমি! তোমার তো রোস্টারে ডিউটি ছিল!’ আমি বললাম, জ্বর ছিল। পাশ থেকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেট্টন সেতারা আপা বললেন, ‘আহা, চেহারা দেখেই তো বুঝা যাচ্ছে, বেচারা জ্বরে কেমন কাহিল হয়ে গেছে!’ উল্লেখ করি, এই সেতারা আপা তখন আমি বিবাহিত কিংবা আমার কন্যাও আছে সে সব তথ্য না জেনেই আমাকে হয়ত তাঁর কোনো আত্মীয়ের পাত্র হিসেবে পছন্দ করেছিলেন! যাহোক শাহজাহান ভাইকে বললাম, তারিক ভাইকে আমার অসুস্থতার কথা জানিয়েছিলাম। শাহজাহান ভাই সাথে সাথে আমাকে লাইব্রেরিতে শাহীন আপার কাছে যেতে বললেন- ‘এখনই যাও, গিয়ে চিঠি টাইপ করতে নিষেধ করো!’ লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি শাহীন আপা আমার জন্য একটা ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ টাইপ করতে শুরু করেছিলেন। এইভাবে আমার আর ‘নোটিশ খেয়ে টাইট হয়ে যাওয়া’ হল না।

একদিন কোনো একটা উপকেন্দ্রে যাবার পথে একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুঁ মারার সুযোগ হল। আমাকে সমাদর করে একটি রুমে বসানো হল। রুমটা ধুলিমলিন, দেখেই মনে হয় ব্যবহৃত হয় না। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার। গণস্বাস্থ্যে বাংলা ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হলেও ঠিকই বুঝতে পারলাম সেখানে ক্যালেন্ডারের যে পাতাটি ঝুলে আছে সেটি মাস তিনেক আগের। মনে মনে ভাবলাম আমরা তবু বাংলা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি, কিন্তু এখানে তো কোনো ক্যালেন্ডারই নাই। এটা ‘৯৬ সালের ঘটনা। তখন মনে হয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন সরকারী কেন্দ্রগুলোর সাথে একসাথে মিলে কাজ করছে না। পরবর্তীতে দেখেছি অনেক এনজিও সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেক ভাল ফল পেয়েছে। কালের পরিক্রমায় ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিবেশ ও কাজের আগাপাশতলা পরিবর্তন হতে দেখলাম। সে সময়ে জিকে’কে সরকারী ব্যবস্থার সাথে কেবলমাত্র টিকাদান কর্মসুচি নিয়েই কাজ করতে দেখেছি। সেই সূত্রে একবার সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জাতীয় টিকা দিবসের এডভোকেসি মিটিং- এ অংশ নিয়েছি। তবে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এনজিওদের সাথে জিকের সম্পর্ক নিবিড় ছিল।

একদিন হাসপাতালের সামনে একটি গাড়ি থেকে নামতে দেখলাম আমার মেডিকেল কলেজের বন্ধু সুব্রত আর দু’বছরের সিনিয়র হিটলার ভাইকে; ওরা তখন আইসিডিডিআর’বির একটি প্রকল্পে কাজের সূত্রে গণস্বাস্থ্যে একটি প্রশিক্ষণে এসেছেন। মনে হল অচেনা ভুবনে নিকট আত্মীয়কে দেখতে পেলাম। সুব্রত এখন প্রথিতযশা অবেদনবিদ, সে আমাকে দু-দুবার অপারেশন থিয়েটারে অজ্ঞান করেছে! হিটলার ভাই এখন গোপালগঞ্জের জনপ্রিয় শিশু বিশেষজ্ঞ।

আমার বন্ধু তিতাস তখন মানিকগঞ্জের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করে, ঢাকা থেকেই মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করে; একদিন সে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে থামল। বাকি সময় কি করে জানতে চাইলে একটু রহস্যময়তার আশ্রয় নিয়ে বলেছিল, ‘বুঝোই তো ঢাকায় কত ধরনের ট্রেনিং-ফ্রেনিং থাকে, সে সব নিয়ে ব্যস্ত থাকি।‘ সরকারী চাকুরিতে ঢুকেও তার কোনো সন্তোষ দেখিনি, দেখিনি মোটিভেশন; যেমনটা আরো অনেকের ক্ষেত্রেই আমার পর্যবেক্ষণ ছিল। এই আলোচনা আরো বড় ও ভিন্ন পরিসরে আলোচনার দাবি করে। এ বছর নবীন ডাক্তারদেরকে দেখছি পররাষ্ট্র, পুলিশ কিংবা প্রশাসন ক্যাডারে আগ্রহী হচ্ছে। তিতাস অনেক কাল হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হয়েছে।

অবশেষে আমি শ্রীপুর যাচ্ছি। তারিক ভাই প্যারামেডিকদের প্রশিক্ষণের মডিউল আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দিলেন, শ্রীপুর প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু আছে। কয়েকদিন পরেই নতুন ব্যাচ আসবে। আমি শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের কাছ থেকে পথ নির্দেশনা ভাল ভাবে বুঝে নিলাম। শ্রীপুরের টেংরা গ্রামের ‘এমসি বাড়ি’তে স্থাপিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হবে। মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ রুটের বাসে মাওনা চৌরাস্তায় নেমে যেতে হবে; সেখান থেকে রিকশায় কিছুটা ইট বিছানো আর কিছুটা গ্রামের মেঠোপথে প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ; পথে একটি অনাথ শিশুসদন পড়বে, সেখান থেকে কাছে – এমন একটি পরিষ্কার নির্দেশনা নিয়ে একদিন দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঢাকা থেকে একটি ব্যাগ নিয়ে শ্রীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম; কিন্তু “হোরেশিও, স্বর্গ ও নরকের মাঝে আমাদের অজানা অনেক কিছুই থাকে!”

সন্ধ্যা নাগাদ মাওনা চৌরাস্তায় নামলাম। অল্প কয়েকটা রিকশা; কেউই আমাকে নিতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। গ্রামের ভিতরে দূরে এক চায়ের দোকানের আলোয় দুটো রিকশা দেখা যাচ্ছে, আমি সেদিকেই হাঁটছি। তখন ব্যাকপ্যাক ছিল না, ব্যাগ বহন করা কিছুটা কষ্টকরই ছিল। আমি হাঁটছি আর পিছন থেকে এক অদ্ভুত কন্ঠ শুনতে পেলাম, “কে তুমি পথিক, হেঁটে চলেছ আমারই মতো একাকী নিঃসঙ্গ?” খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমি কি কোনো পল্লীকবির সাথে হাঁটছি নাকি? যুবকের নাম ছানোয়ার হোসেন, বাড়ি সামনেই। এই গ্রামের নাম পাথার পাড়া। যুবক আমার সাথে পরিচিত হয়ে আমার গন্তব্য জেনে বলল, “এই রাত্রিবেলায় রিকশা করে জিকে’র কেন্দ্রটিতে যেতে কিছু জংগল পড়বে। চোর ডাকাত থাকতে পারে। কাজেই নিরাপদ না।” তার পরামর্শ হল, আমি যেন আজ রাতে তাদের বাড়িতে থেকে সকালে আমার গন্তব্যে রওনা হই। আমার ভয় ভয় করছিল আর ছানোয়ারের অকপট আমন্ত্রণে আমি ভরসাই পেলাম। ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবার সাথে পরিচিত হলাম। রাতে ভাল খাওয়া দাওয়া হল। ভাল ঘুমও হল।

আমার সেই রাত্রির আশ্রয়দাতা ছানোয়ার মাস কয়েক পরে শ্রীপুর জিকে’তে আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সেদিন শ্রীপুর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমিদাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আলহাজ্ব ছফির উদ্দিন আহম্মদ, এমসিএ সাহেবের (এমসিএ মানে হচ্ছে মেম্বার অব কন্সটিটিউশনাল এসেম্বলি) আয়োজনে কোনো একটা বড়সর দাওয়াত ছিল। মরহুম আলহাজ্ব ছফির উদ্দিন আহম্মদ ‘৭০ এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ও ‘৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের গৌরবের সাথে জড়িত। আমার বন্ধু কবি জিললুর রহমান কাকতালীয়ভাবে সেদিন হুট করেই আমাকে দেখতে চলে এসেছিল। জিললুর ভাই আমার এক বছরের সিনিয়র তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যাথলজির ছাত্র। এখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্যাথলজির অধ্যাপক ও স্বনামধন্য কবি। আমার মনে হয় এসব ঝামেলার কারণে সেদিন ছানোয়ারকে আমি যোগ্য সমাদর করতে পারিনি, কিংবা তার একজন সঙ্গী বাইরে অপেক্ষমান ছিল বলে সেও তাড়াহুড়ো করেছিল।

জীবনের পথে পথে শুধু মানুষেরই ঋণ জমে থাকে!

লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কবি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।

(ধারাবাহিক চলবে…)

আরও খবর পেতে পড়ুনঃ ইতিহাসের ডায়েরীভাইরাল নিউজ

Gonoshasthaya kendra, Gonoshasthaya kendra, ‌Gonoshasthaya kendra, Gonoshasthaya kendra,Gonoshasthaya kendra,

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three − 2 =

Back to top button