শোন বলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প; চতুর্থ পর্ব: সিকরুম
আমি চোখ বন্ধ করলেই সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাসপাতাল আর অফিসময় তিন তলা ভবনটা মূর্ত হয়ে উঠতে দেখতে পাই। মেইন গেটে শাদা পোশাকের নারী সিকিউরিটি গার্ড তমা আর নিপাদেরকে পেরিয়ে বামেই হাসপাতাল। হাসপাতালের বাইরে ডান দিকে এক কোনে কীটনাশক বিষ খেয়ে আসা রোগিদের পাকস্থলী পরিস্কারের ব্যবস্থা। অজ্ঞাত কারণে সাভারের সেই অঞ্চল আর ধামরাই থেকে আসা ‘বিষ খাওয়া’ রোগিদের অধিকাংশই ছিল ছেলেরা। সাভারের পুরুষদের ডেয়ারিং ভাবতে পারেন, কিন্তু অভিমানও কম নাই। সাপে কাটা রোগিও আসত কম না।
নিচতলায় রিসেপসন, বামে দুই সারি আউটডোর সেটিং, মা ও শিশু কেন্দ্র (রোববার সকালে যেখানে আবার স্টাফ মিটিং হয়), ডিসপেনসারিতে মমতাজ আপা কিংবা নূরজাহান আপা, ডেন্টাল চেম্বার, শেষে নাইট ডিউটিকালিন ডাক্তারের বিশ্রাম কক্ষ। বছর খানেক বাদে অলটারনেটিভ মেডিসিনের প্রতিভূ হিসেবে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক যোগ দিলে ঐ অঞ্চলেই তার চেম্বার দেয়া হয়। এই কাচঘেরা জায়গাতে আমি একবার ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে ব্যাক রেফারেল হওয়া টিটেনাসের রোগিকে চিকিৎসা দিয়েছিলাম। যেখানে স্টাফ মিটিং হয় বললাম, একবার ভোরবেলা আরিচা রোডের দুর্ঘটনাস্থল থেকে বাসভর্তি আহত-নিহত মানুষ চলে এলে ওখানে গণ বিছানায় শায়িতদেরকে সবাই মিলে প্রাথমিক চিকিৎসা আর সেলাই ফোড়াই করেছিলাম। আরিচা রোডে সেকালে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা হত। অধিকাংশ চলে আসত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। পাগলা ঘন্টি শুনে সব ডাক্তার আর কর্মীরা চলে আসতেন।
যাহোক রিসেপসনে টাংগানো ডিউটি রোস্টারটা দেখে পর পর গ্রামীণ স্বাস্থ্য সমন্বয়কারীর কক্ষ, প্যাথলজি ল্যাব, মিনি ওটি, ডান দিকে এক্স-রে ও আল্ট্রাসাউন্ড। মাঝে এক লুকানো সিঁড়ি বেয়ে মোরশেদ ভাইয়ের অফিসে যাওয়া যেত, জনস্বাস্থ্য গবেষণার অফিস আর কম্পিউটার ছিল সেখানে। সে আমলে কম্পিউটার কক্ষে খালি পায় ঢুকতে হত!
এখন ভাবতে গেলে সে অফিসটাকে গোলক ধাঁধা মনে হচ্ছে। যাহোক, নিচ তলার শেষ মাথায় একটা কম ব্যবহৃত অপারেশন থিয়েটার পার হয়ে দোতলার পথ। দোতলায় একদিকে বিশাল সম্মেলন কক্ষ বা ক্লাস রুম আর অন্যদিকে ছিমছাম একটা লাইব্রেরি যেখানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনেক আন্তর্জাতিক সম্মাননা সাজানো, মেডিকেল বই, পাবলিক হেলথের বই, জার্নাল, কিছু ছিল সাহিত্যের বই। জাফরুল্লাহ চৌধুরী একবার আশির দশকে বিচিত্রার প্রচ্ছদে এসে বলেছিলেন তিনি যা করছেন তা ইউটোপিয়া নয় – “বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে মানুষের জন্যে কাজ করা কি ইউটোপিয়া?” মজার ব্যাপার, এই পাঠাগারে আমি ‘ইউটোপিয়া’র বংগানুবাদ পেয়েছিলাম! যা বলছিলাম, হল রুম আর লাইব্রেরির মাঝে নির্বাহী পরিচালক কাশেম ভাই আর প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী তারিক ভাইয়ের কক্ষ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ এলে তাদের জন্য বরাদ্দ কক্ষ খুলে দেয়া হয় সপ্তাহে দুদিন।
তিন তলায় সিকরুম, যাকে বলে হাসপাতাল। তখন ৭০ বেড ছিল। তিন তলায় উঠে ডান দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসবেন শাহজাহান ভাই কিংবা স্বপন ভাই। পিছন পিছন ওটি স্বাস্থ্যকর্মী আরজিনা, লুনিয়া আর সাথী – ওরা রোগিকে অজ্ঞান করতেও জানে। স্বপন-শাহজাহান জুটি লড়াকু সার্জন, খুব ভাল ক্লিনিক্যাল চোখ; দুজনেই সার্জারি আর এনেস্থিসিয়া দুইই জানেন। মাঝখানে নো-ম্যান্স ল্যান্ড পার হলে বিখ্যাত সিক রুম। ঢুকতেই ডানে জরুরী রোগি, বায়ে লেবার রুম আর প্রসবের জন্য অপেক্ষমান মায়েদের কক্ষ। সে সময় বিখ্যাত ধাত্রী ছিলেন সবিতাদি আর সেলিনা। ওই ঘেরাটোপের মধ্যেই দুটো ইনকিউবেটরের মধ্যে তখনকার নবজাতক বিভাগ! সামনেই কাচে ঘেরা পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ড, উল্টো দিকেই ডিউটি ডাক্তার, সিক রুম ইনচার্জ, স্বাস্থ্যকর্মীরা বসে আছে। ডিউটি ডাক্তার পুরো সাত দিন সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৪ টা কাজ করবেন, আর যিনি নাইট ডিউটি করবেন তিনি বিকেলে এসে তাকে অব্যাহতি দিয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত চালিয়ে নিবেন। আমার সময়ে (জুলাই ‘৯৬-সেপ্টেম্বর ‘৯৮) সিকরুম ইনচার্জ ছিল বনানী কুবি আর বিউটি দি।
আরেকটু সামনে গেলেই বাম দিকে পুরুষ ওয়ার্ড আর ডান দিকে সারি সারি কেবিন – প্রথমটা আইসোলেসন জাতীয় কেবিন, তারপর কেবিন সম্ভবত দু’তিনটা, তারপর আরেকটা মাল্টিপারপাজ কক্ষ – কখনো মেট্রন ক্যাপ্টেন সেতারা বসেন, কখনো স্যাম্পল রাখা হয়- তার সামনেই বড় একটা ওয়ার্ড – মহিলা ও শিশু ওয়ার্ড। নানা ধরনের রোগি আসত, একটা জেনারেল হাসপাতালে যেমন সব ধরনের রোগি আসে। প্রসূতি সেবার সুনাম ছিল, সার্জারি আর যক্ষা চিকিৎসারও সুনাম কম ছিল না।
দিনে বা রাতে জটিল রোগিদের সাধারন ব্যবস্থাপনা দিয়ে সিনিয়র ডাক্তারদেরকে কল দেয়া হত। কল খাতায় রোগির বিবরণ লিখে শাহজাহান ভাই বা স্বপন ভাইকে পাঠাতাম, মেডিসিনের কেস হলে ইকবাল ভাইয়ের কাছে। গভীর রাতে কল খাতা নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা ছুটে যেত সিনিয়রদের খুঁজতে। জরুরী অপারেশনের প্রয়োজনে শাহজাহান ভাই মোটর সাইকেলে করে চলে আসতেন।
রোগিদের ব্যবস্থাপত্র যেমন বাংলায় লিখতে হত, ইনডোরে ভর্তি রোগির ইতিহাস ও কন্টিনিউয়েশন শীটও লিখতে হত বাংলায়। বাংলা মাস আর বাংলা তারিখের চর্চা করতে করতে হুট করে কেউ ইংরেজি তারিখ বা মাসের নাম জিজ্ঞেস করলেও হয়ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। মানুষের অভ্যাস আর চর্চাই তার ব্যক্তিত্ব গড়ে দেয়।
আধুনিক শহর থেকে গণস্বাস্থ্যের ক্যাম্পাসে গিয়ে বাংলা দিনপঞ্জির ভেতরে দিনরাত্রিগুলো সাজিয়ে নিতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছিলাম, ব্যক্তিত্বে কেমন একটা গ্রাম্যতার প্রলেপ পড়তে লাগল যেনবা। গণস্বাস্থ্য থেকে কিছু সমন্বয়হীনতা অর্জন করে থাকলে তা এই বাংলা মাসের চক্করে পড়েই কোন ফাঁকে হয়ে গেছে। বাইরের জগতের সাথে এক প্যারালাল জগৎ তৈরি করে দিত এই বাংলা তারিখ।
বাংলা প্রেসক্রিপশন আর রোগির ইতিহাস নেয়াটা শিল্পের পর্যায়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম বক্ষদেশ আর উদরদেশের স্কেচের মধ্যে রোগির উপসর্গ লিখে। স্যালাইন কত ফোঁটায় চলবে বুঝাতে গিয়ে যে চিহ্ন (@) ব্যবহার করা হয়, সেটা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীরা বুঝবে না বলে সমালোচিত হয়েছিলাম। শাহজাহান ভাই হাসপাতাল সমন্বয়কারী, ইকবাল ভাইও কিছু সময়ের জন্য দায়িত্বে ছিলেন। আমি যখন নগর হাসপাতালে যাব না বলে দিয়েছিলাম, তখন আমাকে হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিল। আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিতে চাইনি, কিন্তু শাহজাহান ভাই আমাকে ডিউটি রোস্টারটা করতে দিয়েছিলেন।
আমি গণস্বাস্থ্যে গিয়ে পেয়েছিলাম ইরান ফেরত শাহাবুদ্দিন ভাই ও কামাল ভাই, সেলিমুজ্জামান ভাই, রেডিওলজিস্ট খোকন ভাই, ডা. যশোদা দুলাল সাহা, জেসিসির এক্স-ক্যাডেট তৌহিদ কামাল ভাই, মানিকজোড় শফিক ভাই আর লিটন ভাই, প্যাথলজিস্ট শাহাদাত ভাই, অনেক সিনিয়র মুসা ভাই, নজরুল, আলাউদ্দিন, আলগিন, নাসরিন, রুনা লায়লা, মাসুদ এদেরকে৷ আবার রোস্টারের দায়িত্ব পেতে পেতে এসে যায় দুই বন্ধু মনোয়ার আর মেসবাহ, রাশিয়ান কার্ডিওলজিস্ট কলিম, মুকিত, তানভির ভাই, নিয়াজ, মনীষা, আমার কলেজের ছোট ভাই হাসান (১ সপ্তাহের জন্য), লুৎফর, শামীম ভাই, রায়হান ভাই, শহিদ ভাই, বিলেত ফেরত সুকুমার দা প্রমুখ। এসেছিলেন ট্রাজিক হিরো বুলগেরিয়া থেকে গাইনি ও প্রসূতিবিদ্যা শিখে আসা রিপন ভাই। প্রত্যেকের সাথেই আলাদা আলাদা স্মৃতি আছে।
আমি এই সিকরুমে আমার দুজন প্রিয় শিক্ষকের দেখা পেয়েছিলাম। একবার শিশু বিশেষজ্ঞ এখলাসুর রহমান স্যার সদলবলে পরিদর্শনে এসেছিলেন মেডিকেল কারিকুলামের অধিকতর উন্নয়নের প্রকল্পের সাথে। এখলাসুর রহমান স্যার চট্টগ্রামে আমার বড় মেয়ের ডাক্তারও ছিলেন, ময়মনসিংহে আমার দুই মেয়েরই ডাক্তার হিসেবে তাঁকে আবারও পেয়েছিলাম। আরেকবার এলেন সার্জারীর রেজাউল করিম স্যার – উনাকে আনা হয়েছিল প্রস্তাবিত মেডিকেল কলেজে যোগদানের জন্য প্রজেক্ট ভিজিট করানোর জন্য। স্যার চেষ্টা করতেন ডাক্তারের দরকারি শিষ্টাচারগুলো ছাত্রদেরকে শিখাতে। রেজাউল করিম স্যার আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন – এখনো কবিতা লিখি কিনা!
গত সপ্তাহে পরিণত বয়সে রেজাউল করিম স্যার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
কবিতা কি লিখব! বেতন পেয়ে ক্যান্টিন আর গণ বিপণন এর টাকা মিটাতে গিয়েই বেশিরভাগ টাকা দরোজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে, তো সৃজনশীলতা জানালাপথে পালিয়ে যাচ্ছে! সারা মাস কাটত বাংলা মাস শুরু হবার অপেক্ষায়, মাসের ১৫ বা ২০ তারিখে বেতন পাওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। সিকরুমে রোগিদের পরিশোধিত বিলের টাকা জমা থাকত। প্রতিমাসের মাঝামাঝি এসে আমি বনানীর কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে আবার বেতন পেয়ে শোধ করে দিতাম। আবার কুমকুম বেতন পেত আইসিডিডিআর’বির হিসেবে ইংরেজি মাসে; আমি বাংলা মাসে বেতন পেলে ওকে পাঁচশত টাকা দিতাম আর সে বেতন পেলে আমাকে পাঁচশত টাকা ফেরত দিত।
আমি ইন্টার্নশিপের সময় কবিতা চর্চা করতে গিয়ে যা কিছু শিখতে পারিনি এই সিকরুমে কাজ করে তা শিখেছিলাম।
লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কবি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।
(চলবে…)
আরও খবর দেখুনঃ করোনা ভাইরাস আপডেট – ইতিহাসের ডায়েরী
Historical News Bd, Historical News Bd ,Historical News Bd