প্রকৃতি ও জলবায়ূ

অতিথি পাখিকে অতিথি হয়ে থাকতে দিন

আদিকাল থেকেই পাখিদের সাময়িক অন্তর্ধান ও পুনরায় আবির্ভাবের রেওয়াজ রয়েছে; যা আজও মানুষের কাছে রহস্যময়। ধারণা করা হয়, পাখিদের স্থানান্তর শুরু হয় প্রায় ৫ কোটি বছর আগে।

অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যখন শীতকালে পাখিদের তাদের স্ববাসে দেখা যেত না; তখন মানুষ মনে করত, পাখিরা শীতকালটা পানির নিচে ডুব দিয়ে অথবা সরীসৃপের ন্যায় গর্তে কাটায়। পরে বিজ্ঞানীরা মানুষের ভুল ভাঙতে সক্ষম হন। পাখিরা পরিবেশগত চাপে, আরামদায়ক পরিবেশের আশায় ও জিনগত নিয়মের কারণে দেশান্তরী হয়।

কোনো কোনো তত্ত্বমতে, পাখিদের উৎপত্তি হয়েছিল উত্তর গোলার্ধ্বে এবং প্লায়োস্টোসিন সময়ের হিমবাহ তাদের বাধ্য করেছিল দক্ষিণে আসতে আর সে অভ্যাসগত কারণেই পাখিরা আজও দক্ষিণে আসে। অন্য এক তত্ত্বমতে, পাখিদের আবির্ভাব দক্ষিণ গোলার্ধ্বেই; তবে খাদ্যের প্রাচুর্য ও অন্যান্য অনুকূল পরিবেশের কারণে তারা সেখানে চলে যায়। পূর্বপুরুষের ভিটায় তারা প্রতিবছর একবার আসে।

তবে পাখিদের প্রথম আবির্ভাব যেখানেই হোক না কেন; বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, খাদ্য ও পরিবেশগত সুবিধার জন্য তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশান্তর হয়।

বস্তুত প্রচণ্ড শীতে স্ববাসে যখন বাঁচা-মরার প্রশ্ন দেখা যায়, দেখা দেয় খাদ্য ও আশ্রয়ের চরম সঙ্কট; তখন শীতপ্রধান দেশের পাখিরা অতিথি হয়ে আসে আমাদের দেশে। একটু উষ্ণতা, আর্দ্রতা ও শ্যামলিমার আশায় হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। খুঁজে নেয় নির্জন স্থান, জলাশয় ও বনাঞ্চল। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব পাখি ৬-৭ মাসের জন্য শীতের শুরুতে আশ্রয় নেয়।

উড়ে বেড়ায় হাওর, বিল ও বিভিন্ন জলাশয়ে। দুর্ভাগ্যজনক হল, অতিথি পাখি এদেশে অতিথি হয়ে থাকতে পারছে না; এক শ্রেণীর শিকারীর হাতে তারা শিকার হচ্ছে। পাখিরা মানুষের কাছে একসময় বিস্ময় হিসেবে থাকলেও আজ তা কারও কারও কাছে সৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে। অতিথি পাখি শিকার করা হলে ভবিষ্যতে হয়তো এদের আসা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। বন্য প্রাণী ও পাখিরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

আমাদের দেশে প্রতিবছরই বন্যপ্রাণী যেমন কমছে; তেমনি অতিথি পাখির সংখ্যাও কমছে। সাম্প্রতিককালে বেঙ্গল ফোবিক্যান, সারস ও বুঁচাহাস বিলুপ্তির পথে। ফলে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, এর মধ্যে দুইশ’ প্রজাতির রয়েছে দেশান্তরী পাখি। প্রতিবছর বাংলাদেশের যেসব স্থানে পাখি আসে, সে স্থানগুলো হচ্ছে- মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ঢাকার পিলখানা, বালুচরা, মহেশখালী দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, (চর ওসমান) শাহীবানীচর, সন্দীপ, হাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর, যামিরচর, মৌলবীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, জোনাকচর, চরভাটা, শিবালয়, কামালপুর, হালহাওর, হাকালুকি হাওর, চরকুকড়িমুকড়ি, বুড়িগঙ্গা নদী, আগুনমুখা, গলাচিপা, খেপুপাড়া, কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, হোয়াইকিয়ং, শাহপুরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম, চরমানিক, চরদিয়াল, চরমনতাজ, উড়িরচর, বায়ারচর, মুক্তাগাছার রৌয়াবিল, বড়বাইসা বিল, নেত্রকোনার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ হাওর, পঞ্চগড়ের ভিতরগড় ও পদ্মার চর।

হিমালয়, সাইবেরিয়া, আসাম, ফিলিপিন্স, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ পশ্চিম চীনের মালভূমি, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, তিব্বতের উপত্যকা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রতিবছর শীতের প্রকোপে পাখিরা এখানে আসে। এসব পাখির আগমনের প্রথম অবস্থায় পালক থাকে না। সেখানে অতিরিক্ত শীতের কারণে পালক পড়ে যায়। বাংলাদেশে এসে কিছুদিনের মধ্যে অনুকূল হাওয়ায় তাদের পালক গজায়। শীতে যেসব পাখি আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসে তাদের মধ্যে বালিহাঁস, চখাচখি, রাজহাঁস, মানিকজোড়, গাংকবুতর, নারুদ্দি, চিনাহাঁস, নাইরাল ল্যাঙ্গি, ভোলাপাখি, হারিয়াল, বনহুর, বুরলিহাস, সিরিয়া পাতিরা, পিয়াংচিনা, কবালি, যেনজি, প্রোভায়, নাইবাল, ডেলা ঘেনজি, গ্রাসওয়ার, গেন্ডাভার ও বারহেড অন্যতম। এদের কেউ কেউ পুরো শীতকাল আমাদের দেশে কাটায়। বাকিরা আমাদের সীমানা সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে।

রাজধানীর কাছাকাছি যে দুটো স্থানে প্রতিবছর অতিথি পাখির আনাগোনা হয়; সে দুটো স্থান মিরপুর চিড়িয়াখানা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

স্থান দুটো ঢাকায় বলে অনেক পর্যটক ও দর্শক আনায়াসেই পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়। এই ক্যাম্পাসে পাখিদের জীবনযাত্রা ও পাখিসম্পদ নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে সেন্টার ফর নেচার স্টাডিজ নামে একটি সংগঠন রয়েছে।

প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে এই ক্যাম্পাসকে পাখির অভায়রণ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। ছাত্রছাত্রীদের সচেতনতা ও অনুকূল প্রকৃতি ঘিরে এই ক্যাম্পাসে প্রকৃতির অবারিত লালনভূমি ও পাখিশালা গড়ে উঠছে।

ঢাকার কাছাকাছি অতিথি পাখিদের নিরাপদস্থান মিরপুর চিড়িয়াখানা। এখানে কিছু অসাধু কর্মচারী, মাস্তান ও চিড়িয়াখানার নিম্নশ্রেণির ঠিকাদারদের উৎপাতের কারণে অতিথি পাখিদের পুরোপুরি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এসব স্থানে পাখিদের খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশপাশি পাখিদের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত বলে দর্শকরা জানিয়েছেন। এক জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর এখানে প্রায় এক লাখ পাখি আসে। মিরপুর চিড়িয়াখানার এই লেকে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছরই পাখি আসছে।

নির্দিষ্ট সময় অন্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক এখানকার পাখি গণনা করেন বলে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়। এই লেক দুটো বেশ বৈচিত্র্যময় পরিবেশে সৃষ্টি। বিভিন্ন গাছপালায় ঘেরা থাকায় পাখিরা নিজেদের ইচ্ছামতো এখানে ঘোরাফেরা করতে পারে। কিছু কিছু পাখি আছে খাবারের অন্বেষণে ও ভ্রমণের জন্য দিনেরবেলা বিভিন্ন স্থানে যায়; আবার রাতে ফিরে আসে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানের চরাঞ্চল আবাদি ভূমিতে পরিণত হওয়ায় অতিথি পাখিদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে যেসব পাখি জঙ্গলে ঠাঁই খুঁজত; তারাও এদেশে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই পাখি শিকার বন্ধের পাশপাশি পাখিরা যাতে নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারে, সেদিকে সবার দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

গবেষক ও আঞ্চলিক পরিচালক, বাউবি। সুত্র যুগান্তর

 

 

আরও খবরঃ প্রকৃতি ও জলবায়ূ

Tag: Prothom Alo Paper, prothom alo paper news, prothom alo paper bd

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × two =

Back to top button