খোলা জানালাশোবিজ

‘একদিন এই ঝড় থেমে যাবে, মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে’

অভিনেতা আজম খান একাধারে একজন অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব, ছোট পর্দার জনপ্রিয় মুখ – আবার কর্পোরেট কমিউনিকেশন্সেও কম যান না। একটি বেসরকারি ব্যাংকের গ্রুপ চিফ কমিউনিকেশন্স অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। করোনাবসরে তিনিও আর বসে থাকতে পারলেন না, হাতে তুলে নিয়েছেন লেখনী। তুলে ধরেছেন নিজের ভাবনাগাঁথা। পজিটিভ নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো তাঁর সেই লেখা:-

“আবার জীবন শুরু হোক জীবনের নিয়মে
– আজম খান –
আজ ৩৪ দিন ধরে আমি বাসায়। প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হবার পরে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষনা করে। আর সেদিন থেকেই হোম কোয়ারান্টাইনে আমি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম সনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। তারপরও আমি অফিস করেছি ২৫ মার্চ পর্যন্ত। এর মধ্যে অবশ্য একদিনের জন্য অফিসের কাজে গিয়েছিলাম যশোর আর সিলেট।
তবে শোবিজে কাজ করেছি ১৭ মার্চ পর্যন্ত। সেদিন শেষ কাজ করেছিলাম একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ওভিসিতে। কাজ করার কথা ছিল ২৮ মার্চ পর্যন্ত ঈদের জন্য কয়েকটা নাটকের। কিন্ত ১৮ মার্চ থেকেই প্যাকআপ হতে শুরু করে সেই কাজগুলি।
অদৃশ্য আর প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা টের পাচ্ছিলাম গত ডিসেম্বর থেকেই। কিন্তু তখনো আমরা বুঝে উঠতে পারিনি, কি করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো আমরা। আমাদের কোনরকম প্রস্তুতিও ছিল না সেই অর্থে।
তারপরও সময় আর জীবন কোন কিছুই কখনো থেমে থাকে না। এই ৩৪ দিন হোম কোযারাইন্টাইনে থেকে নতুন পদ্ধতিতে অফিসের কাজ করলাম ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নামে। আমি কাজ করি দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকের কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান পদে। আর তাই এখনকার ডিজিটাল পৃথিবীতে বাসায় বসে অফিসের কোন কাজই আর বাকী থাকে নি করার।
কিন্তু এই সময়ে ভীষণ ভাবে মিস করছি শোবিজের কাজকে। এই বছরটা শুরু হয়েছিল অনেক ব্যস্ততার মধ্যে। নাটক, টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপনের কাজ দিয়ে। ঈদের জন্যও কাজ করা শুরু করেছিলাম।
প্রায় পাচ বছর আগে আমি যখন এই শোবিজে এসেছিলাম তখন কখনো ভাবিনি এই মায়ার জগতে এভাবে জড়িয়ে পড়বো। কাজ করতে গিয়ে কত মানুষের সাথে যে পরিচয় হয়েছে এই সময়ে। তাদের কেউ পরিচালক, কেউ সহকারী পরিচালক, কেউ অভিনয় শিল্পী, কেউ ডিওপি, কেউ লাইটম্যান, কেউ মেকআপ ম্যান, কেউ প্রোডাকশন বয় কত মানুষ। কত গল্প, কত কথা, কত স্মৃতি তাদের সাথে।
এই সময়ে একটা জিনিষ আমি লক্ষ্য করেছি। এই জগতের মানুষেরা অনেক আবেগপ্রবণ আর সৃজনশীল। আর তাই তারা কখনো কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না, নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর স্বকীয়তার জন্য। অথচ বাস্তবতা হল তারা কিন্তু প্রতিদিনের আয়ের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেরই কাজ না থাকলে উপার্জন থাকে না। ভাবা যায় যেই সেক্টরের মানুষেরা প্রতিবছর এতোগুলি চ্যানেলের জন্য কত সৃজনশীল প্রোগ্রাম করছেন মানুষের বিনোদনের জন্য অথচ তাদের জীবিকা কত অনিশ্চিত। যাদের নেই কোন উৎসব ভাতা, স্বাস্থ্য ঝুকি ভাতা বা অবসর ভাতা।
তারপরো এই মায়ার জগতটা মনে হয় এমনি। এভাবেই চলে আসছে বহুদিন ধরে। যেখান থেকে ফেরা হয় না। ফেরা যায় না। সবাই মিলে কেমন এক অদৃশ্য পরিবার। সেই পরিবারটা আজ স্তব্ধ, থেমে আছে। সবাই যার যার ঘরে বসে আছে কর্মহীন হয়ে।
উত্তরা বা পুবাইলের শুটিং পাড়া আজ শুন্য। নেই কোন নাটকের সেট, নেই কোন লাইট, ক্যামেরা আর একশন। শোবিজের এত বড় একটা ক্ষেত্রের এতগুলি মানুষ আজ কর্মহীন হয়ে অলস জীবন পার করছে এক বিশাল অনিশ্চয়তায়।
বর্তমান সময়ের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে সব কাজই হয়তো কম আর বেশী করা যায় বাসায় থেকে। শুধু শোবিজের কাছ ছাড়া। কারন এই শোবিজের কাজটা হল একটা বিশাল টিম ওয়ার্ক। যেখানে একজন পরিচালক থেকে শুরু করে প্রোডাকশন বয় পর্যন্ত অনেকগুলি মানুষ জড়িত প্রত্যেকটা প্রোজেক্টে।
আর তাই হোম কোয়ারান্টাইনে থেকেও অনেকে আজ লেখালেখি করছেন, গান গাইছেন, কবিতা আবৃতি করছেন, ছবি আঁকছেন, বই পড়ছেন, ইন্টার্ভিউ দিচ্ছেন, টক শো করছেন, অফিসের বিভিন্ন কাজ করছেন। ডাক্তাররা অনলাইনে রোগী দেখছেন। সবাই সব করছেন। শুধু মাত্র কাজ হচ্ছে না অভিনয় জগতের।
সব টিভিতেই এখন রিপিট প্রোগ্রাম হচ্ছে, পুরানো নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা, বিনোদনমমুলক অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। এভাবেই পার করেছি আমরা বাংলা নববর্ষ । হয়তো আসন্ন ঈদও আমরা এভাবে পার করবো পুরানো সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দেখে। অথচ এখন এই সময়ে কত কাজ হবার কথা ছিল। কত ব্যস্ত থাকে ঈদের এই সময়টা। এটাই তো ছিল কাজের সবচেয়ে বড় একটা মৌসুম।
একদিন হয়তো এই ঝড় থেমে যাবে। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। সবাই আবার ফিরে যাবে কাজে। আবার কাজ শুরু হবে এই রুপালী শোবিজে। লাইট, ক্যামেরা আর একশনে মুখরিত হবে শুটিং পাড়া। কিন্তু যেই শুন্যতা, অনিশ্চয়তা আর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এই শোবিজে গত দুই মাস ধরে তা কি আমরা সবাই কাটিয়ে উঠতে পারবো? আর কেউই কিন্তু জানি না, আর কতদিন আমরা এভাবে থেমে থাকবো। ঘুরে দাড়ানোর জন্য এত বড় একটা ক্ষেত্রে তারপরো নেই কোন সরকারি সহায়তা বা প্রণোদনা।
আবার জীবন শুরু হোক জীবনের নিয়মে। হাসি আনন্দ আর কোলাহলে। লাইট, ক্যামেরা আর একশনে।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − seven =

Back to top button