ক্রিকেটখেলাধুলা

কম খেয়ে তামিমের জন্য টাকা জমাতেন নাফিস

ক্রিকেটের সব ভাইদের গল্পটা স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহদের মত হয় না। নাফিস ইকবাল ও তামিম ইকবাল যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে পারেননি একসঙ্গে। তবে ক্রিকেট মাঠে একসঙ্গে রূপকথা রচনা করতে না পারলেও মাঠের বাইরে তাদের আছে চমকে দেওয়া গল্প। দুজনকেই খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় মাশরাফি বিন মুর্তজা জানালেন, নাফিসের অবিশ্বাস্য ত্যাগের কারণেই আজকের এই পর্যায়ে আসতে পেরেছেন তামিম।

বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে একসময় নাফিসের সঙ্গে খেলেছেন মাশরাফি। পরে দুজন একসঙ্গে খেলেছেন জাতীয় দলেও। গড়ে ওঠে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একটা সময় নাফিস ছিটকে গেলেন দল থেকে। এলেন তার ছোট ভাই তামিম। সময়ের পরিক্রমায় তামিমের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে মাশরাফির। বয়সের ব্যবধানকে মাড়িয়ে দুজন হয়ে উঠেছেন কাছের বন্ধু।

ফেইসবুক লাইভে সোমবার রাতে ঘণ্টাখানেক প্রাণবন্ত আড্ডা দেন তামিম ও মাশরাফি। দুজনের সম্পর্কের উষ্ণতার সূত্র ধরেই তামিম প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি আমাকে প্রথম কবে দেখেছিলেন, মনে আছে?”

সেই দিন ও দেখা হওয়ার ঘটনা, মনে করতে একটুও ভাবতে হয়নি মাশরাফিকে।

“তোর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, তুই হাফ প্যান্ট পরা, আর স্যান্ডো গেঞ্জি। আমি আর তোর ভাই নাফিস (ইকবাল) তো বন্ধু, চট্টগ্রামে টেস্ট ম্যাচের সময় গিয়েছিলাম। দেখলাম তুই আরও দুই-তিনজন বন্ধুর সঙ্গে গাড়ী নিয়ে খেলছিস। আমার-তোর বাচ্চারা এখন যেমন খেলে গাড়ী নিয়ে।”

“আমি বললাম, ‘ভাইয়া তুমি ভালো আছো?’, তুই বললি, ‘জ্বী ভাইয়া’, সেটা বলতেও লজ্জা পাচ্ছিলি। সেই তামিম এখন বাংলাদেশের অধিনায়ক…নাইস টু সি!”

নাফিসের সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়েছিলেন, এটা মনে হতেই মাশরাফি নিজে থেকেই বললেন নাফিসের অবদানের কথা।

“একটা কথা বলি, তোর আজকে এই পর্যায়ে আসার পেছনে তোর ভাইয়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। তোর বাবা তো অন্যরকম মানুষ ছিলেন। তোর মা, চাচারা, যে যেটাই বলুক, তোর ভাইকে তো আমি কাছ থেকে দেখেছি, নাফিস তোর জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা অবিশ্বাস্য।”

তামিম-নাফিসের বাবা ইকবাল খান ছিলেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড়। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম লিগে প্রথম সেঞ্চুরি এসেছিল তার ব্যাট থেকে। ফুটবলে চট্টগ্রামে তো বটেই, খেলেছেন ঢাকার প্রথম বিভাগেও। এরপর ছিলেন কোচ। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও চট্টগ্রামে তার ছিল বড় অবদান। ২০০০ সালে তিনি মারা যান, তামিমের বয়স তখন ১১, নাফিসের ১৫।

মাশরাফি জানালেন, বাবার অনুপস্থিতিতে ভাইকে কতটা আগলে রাখতেন নাফিস। জাতীয় দলের সঙ্গে বিভিন্ন সিরিজ বা সফরে দৈনিক ভাতা থেকে টাকা বাঁচাতেন ভাইয়ের জন্য।

“বাবা মারা যাওয়ার পর তোর মা সংসার সামলেছে। কিন্তু তোর জন্য তোর ভাই যা করেছে, আমরা জানি। মনে আছে, এক পেন্সের বার্গার খেত নাফিস। আমি একদিন ওকে বলেছিলাম, ‘তুই যদি শরীরে না দিস (যথেষ্ট খাবার), তাহলে বাঁচবি কীভাবে আর খেলবি কীভাবে।’ পরে বুঝেছি, ও আসলে তোর জন্যই সব করত। টাকা বাঁচাত তোর জন্য, তুই যেন একটা ভালো ব্যাট দিয়ে খেলতে পারিস।”

নাফিস নিজেও দারুণ সম্ভাবনাময় হিসেবে এসেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। প্রতিভা, টেকনিক সব মিলিয়ে তাকে ভাবা হচ্ছিল দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার অসাধারণ এক সেঞ্চুরিতেই নিশ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।

তবে নানা কারণে পূর্ণতা পায়নি নাফিসের সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থমকে গেছে ১১ টেস্ট ও ১৬ ওয়ানডেতে। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে গেছেন এরপরও, কিন্তু ২০০৬ সালের পর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি তার। জাতীয় দলে দুই ভাই একসঙ্গে খেলে বাবার স্বপ্ন পূরণ করাও হয়নি। ২০১৮ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে শেষবার মাঠে নামা নাফিস এখন ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। পাশাপাশি নানা সময়ে বিভিন্ন দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে আছেন ক্রিকেটের সঙ্গেও।

তামিমের সঙ্গে আড্ডায় নাফিসের ক্যারিয়ার নিয়ে খানিকটা আক্ষেপও করলেন মাশরাফি।

“নাফিসের কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার সুযোগ ছিল। সবসময় বলেছি, এখনও বলি। হতে পারেনি কোনোভাবে, হয়তো ওর সবকিছু তুই (তামিম) পেয়েছিস।” সূত্র বিডিনিউজ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × one =

Back to top button