প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর বিষাক্ত ছোবলে যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। আকারে ছোট্ট এই আণুবীক্ষণিক জীব সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার প্রাণ। একই সঙ্গে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই মরণব্যাধির নেই কোনো ওষুধ, নেই প্রতিষেধকও। শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা।
এমতাবস্থায় বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে এই মরণব্যাধি থেকে বাঁচার একটা ওষুধ বা ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে এখনো সফলার মুখ দেখেননি কেউ। নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় নানা রকমের ওষুধ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। প্লাজমা থেরাপি, হাইড্রোক্লোরোকুইন, রেমডেসিভির, এইডসের ওষুধ, ফ্লু -এর ওষুধে কাজ করছে- এমন নানা সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন সময়ে ছড়িয়েছে। তবে এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হলো ‘স্টেম সেল থেরাপি’। কিন্তু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় এর একটাও এখনো সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি।
কিন্তু এবার কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নতুন আশা জাগাচ্ছে ‘স্টেম সেল থেরাপি’। এরই মধ্যে নাকি এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রাণে বেঁচেছেন ৭ জন কোভিড আক্রান্ত রোগী। এদের মধ্যে ৬ জন ইজরায়েলের আর একজন আমেরিকার বাসিন্দা। মৃত্যুর পথযাত্রী এই ৭ জন কোভিড-১৯ আক্রান্তের ফুসফুস থেকে শুরু করে হার্ট, কিডনি, লিভার সবই প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল। গতানুগতিক চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাদের দেওয়া হয় প্রসূতি মায়ের প্ল্যাসেন্টা থেকে সংগ্রহ করা বিশেষ ধরনের কোষ বা স্টেম সেল। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘প্লুরিস্টেমস অ্যালোজেনিক প্ল্যাসেন্টাল এক্সপ্যান্ডেড সেল’ বা ‘পিএলএক্স সেল’। এতে কাজ হলো ম্যাজিকের মতো।
স্টেম সেল থেরাপি কী?
ভারতের বিখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও ভায়রোলজিস্ট অমিতাভ নন্দীর মতে, ‘সন্তান জন্মানোর পর মায়ের শরীর থেকে যে প্ল্যাসেন্টা বেরিয়ে আসে, তার মধ্যে রয়েছে এই সব স্টেম সেল। বিজ্ঞানীরা এখান থেকে কোষ নিয়ে তাকে পরিণত করেন স্মার্ট কোষে। এমনভাবে প্রোগ্রামিং করা হয় যে, সেই কোষ যে শরীরে যাবে, সেই শরীরের প্রয়োজন বুঝে, ঠিক তার মাপ মতো ওষুধ তথা প্রোটিন নিঃসরণ করবে। স্টেম সেল থেরাপি মূলত এটিই।’
কীভাবে কাজ করে এটি?
অমিতাভ নন্দীর কথায়, ভাইরাসের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে ধ্বংস করার চেষ্টায় কখনো কখনো অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর পরিমাণে সাইটোকাইন রাসায়নিকের প্রবাহ শুরু হয়, যাকে বলে সাইটোকাইন স্টর্ম। এদের মধ্যে কিছু রাসায়নিক প্রদাহ ঘটিয়ে ফুসফুসের প্রচুর ক্ষতি করে। ফলে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে অকেজো হতে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রত্যঙ্গ। দেখা দেয় মাল্টি অরগ্যান ফেলিওর। রোগীও মারা যান। প্রোগ্রামিং করে তৈরি করা কোষ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করালে তারা শরীরের ভেতরে প্রোটিন তথা ওষুধ তৈরি করে। ওষুধ বলতে দুই ধরনের প্রোটিন। একটি প্রদাহ কমায়। অন্যটি অতিসক্রিয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। একে বলে ‘ইমিউন মডিউলেশন’। ফলে অক্সিজেনের পরিমাণ ফের নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রদাহের প্রকোপ কমাতে শুরু করে। অকেজো হতে থাকা প্রত্যঙ্গরা ফিরে পায় তাদের কার্যক্ষমতা। তবে এই স্টেম সেল পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপটুকু কেবল সারা হয়েছে। তাতে সাড়া মিলেছে ভাল। আরও অনেক পর্যায় এর বাকি। তবেই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই স্টেম সেল থেরাপি বিশ্বব্যাপী সমাধান হয়ে উঠতে পারবে কি-না বোঝা যাবে।
ইজরায়েল ও আমেরিকার এই সাত জন রোগীর বেলায় ইজরায়েলের ‘প্লুরিস্টেম থেরাপিউটিক’ নামক সেল থেরাপি সংস্থার বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। সংস্থার ডিরেক্টর ইয়াকি ইয়ানায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘সাধারণ ওষুধপত্রে যেমন ডোজ আগে থেকে ঠিক করা থাকে, সেই মাত্রাতেই শরীরের ভিতরে গিয়ে প্রোটিন থেকে ওষুধ তৈরি করতে পারে এই স্টেম সেল বা পিএলএক্স সেলগুলো।’
চিকিৎসকরা আশা করছেন ‘স্টেম সেল থেরাপি’ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি কার্যকরি অস্ত্র হতে পারে।
এ দিকে, শুক্রবার (২৪ এপ্রিল) রিজেরনারেটিভ মেডিসিন কোম্পানি ‘মেসোব্লাস্ট’ গুরুতর ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত ৩০০ জন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর এই থেরাপির পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। স্টেম সেল চিকিৎসা কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে কীভাবে কাজ করে সেটা নির্ধারণ করাই হবে এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য।
সূত্র- ডব্লিউএলএনএস, আনন্দবাজার।
