Lead Newsজাতীয়

কেবল প্রশিক্ষণের জন্যই আড়াই হাজার কোটি টাকা!

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি কর্মসূচির সংশোধিত প্রস্তাবে প্রশিক্ষণের জন্য ২ হাজার ৫০২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা চেয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য সংশোধিত প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়টি।  কর্মসূচিটির নাম চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (চতুর্থ এইচপিএনএসপি) (প্রথম সংশোধিত-প্রস্তাবিত)। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। শেষ হওয়ার কথা আছে ২০২২ সালের জুনে। প্রকল্পের মেয়াদ ১ বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত করারও প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এই কর্মসূচির প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের জন্য ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ৩১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সংস্থান রাখা হয়েছে, যা মূল অনুমোদন থেকে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে ১০৭ কোটি ৮৫ লাখ এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ১২৬ কোটি ৪ লাখ টাকা বেশি। এই কর্মসূচির আওতায় অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে এ পর্যন্ত ৭৫১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ৯৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে, যা প্রস্তাবিত সংস্থানের ৩৪ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানান, যক্ষ্মা কর্মসূচি কর্মসূচি, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বা কীভাবে টাকাপয়সার হিসাব, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ, অসংক্রামক রোগ, মানসিক রোগ, ম্যাটারনাল চাইল্ড হেলথ এ রকম অনেক বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ হয়। অনেকগুলো অপারেশনাল প্ল্যান আছে। প্রতিটি অপারেশনাল প্ল্যানের জন্য কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব প্রশিক্ষণে দৈনিক ভাতা, খাতা-কলম, ব্যাগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া কেউ জেলা পর্যায় থেকে ঢাকায় প্রশিক্ষণ নিতে এলে তাঁকে টিএ, ডিএ (যাতায়াত খরচ) দেওয়া হয়। এভাবে এই অর্থ খরচ করা হয়।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়নে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ রয়েছে। দেশে-বিদেশে এসব প্রশিক্ষণ হয়। যেকোনো প্রকল্পের অধীনেও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি করা হয়।

প্রশিক্ষণের জন্য এত অর্থ চাওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। করোনার কারণে দেশি-বিদেশি সব প্রশিক্ষণ এখন সম্পূর্ণ অনলাইনে হওয়ার কথা উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, ‘প্রশিক্ষণের জন্য এত অর্থ চেয়ে যে ব্যাখ্যাই প্রদান করা হোক না কেন, মনে রাখতে হবে এখানকার যে বিশ্ব, অদূর ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ নামক ব্যবসা থাকবে না। কারণ, এখন যেগুলো সত্যিকারের প্রশিক্ষণ, সেগুলো অনলাইনে হয়। সেটা দেশি হোক কিংবা বিদেশি। আর অনলাইন প্রশিক্ষণে খরচ নেই বললেই চলে। সেখানে এ রকম বিশাল অর্থ খরচের কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, এর সঙ্গে কোনো পাঁয়তারা রয়েছে। যাঁরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেবেন এবং অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলেও জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

এক পর্যায়ে এসে এসব প্রশিক্ষণ আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হবে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বলেও জানা গেছে।
প্রকল্পটি যাচাই–বাছাই করছে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। এর সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম  বলেন, ‘এই প্রকল্পের পিইসি সভা এখনো শুরু হয়নি। তাই এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’
কত প্রশিক্ষণ হবে জানতে চাইলে নাসিমা বেগম বলেন, ‘এই কর্মসূচির আওতায় কতগুলো প্রশিক্ষণ হবে, তা এখন খেয়াল নেই। তা ছাড়া আমরা এখনো মিটিং শুরু করিনি। ২৮ জুলাই মিটিং শুরু হবে। এক দিনে মিটিং সম্ভব না, কারণ এই কর্মসূচির মধ্যে ৩১টি অপারেশনাল প্ল্যান আছে। একেকটা অপারেশনাল প্ল্যান একেকটা প্রকল্পের মতো। চার-পাঁচটা অপারেশনাল প্ল্যান নিয়ে একটা করে সভা করব। এ রকম ৬টি সভা হবে। তারপর বলা যাবে।’ তিনি বলেন, সভায় বসলে বলা যাবে প্রশিক্ষণ ব্যয় স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক।

কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘পিইসি সভায় অনুমোদনের পর একনেকে যাওয়ার আগমুহূর্তে প্রকল্পটি আমার কাছে আসে। তখন মন্ত্রী, সচিব, ঠিকাদার, তদবিরবাদ—সকল শক্তি এসে আমার ওপর হাজির হয়। যে, আপনি তাড়াতাড়ি এটা একনেকে নিয়ে যান। আর একনেক সভাতে বসে এগুলো পরীক্ষা ওভাবে করা যায় না।’

এম এ মান্নান বলেন, ‘পিইসির পর যখন প্রকল্প আমার কাছে আসে, তখন তাদের ওপরেই তো আমাকে ভরসা করে চলতে হয়। কারণ, পিইসি প্রধান একজন সদস্য (সচিব)। তাঁর নিচে বিশাল বাহিনী মাসব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তারা আমাকে দেয় চূড়ান্ত অবস্থায়। আমি আবার এটাকে কেন রিওপেন (পুনরায় দেখতে) করতে যাব। এতে সময় নষ্ট হবে, উচিতও না। কারণ, আমার আর সচিবের মধ্যে কী এমন তফাত আছে। তার ব্রেন, আমার ব্রেনের কাছাকাছি। আমি যা বুঝি সেও তা বোঝে।’ তারপরও মনে প্রশ্ন উঠলে সদস্যের কাছে প্রকল্প ফেরত পাঠান বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) মো. আব্দুস সালাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাস হয় নাই, কিছু হয় নাই, কেবল গেছে পরিকল্পনা কমিশনে। তা ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ প্রকল্প পাঠাইছে, তাদের জিজ্ঞাসা করলে ভালো হয়।’

সূত্র বলছে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নিপোর্ট, ওধুষ প্রশাসন অধিদপ্তর, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর/গণপূর্ত অধিদপ্তর।

কর্মসূচিটির মূল খরচ বাবদ বরাদ্দ ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৮৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবে ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বা ৩৩ হাজার ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা খরচ বাড়িয়ে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০১৭ সালে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আরও তিনটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one + 18 =

Back to top button