শিক্ষাঙ্গন

জাবিতে সেশনজটের আশঙ্কা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় গেল ৫ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। বন্ধের প্রায় একমাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর এতে করে দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

জাবির ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে সম্মান প্রথমবর্ষে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েও অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে কয়েক হাজার নবীন শিক্ষার্থীদের। অধ্যয়নরত প্রথম ও দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীদের আসন্ন চূড়ান্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরও কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নির্ধারিত সময়ের পরে প্রথমবর্ষের ক্লাস শুরু করা, অ্যাকাডেমিক রুটিন অনুযায়ী ক্লাস-পরীক্ষা নিতে শিক্ষকদের অনীহা-স্বেচ্ছাচারিতা, সান্ধ্যকালীন কোর্সে বেশি সময় দেওয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, প্রশাসনিক কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকাসহ শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে বিভাগগুলো বিভিন্ন বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা একসঙ্গে নিতে পারে না। এতে করে আগে থেকেই সেশনজটের কবলে ছিল কিছু বিভাগ। সম্প্রতি অনির্দিষ্টকাল বন্ধ এই সেশনজটকে আরও প্রকট করে তুলেছে।

জানা যায়, গত বছরের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রথম থেকেই তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল- প্রকল্পের আওতায় ছয়টি হলের মধ্যে ছেলেদের তিনটি হল নির্মাণের জায়গা পুনরায় বিবেচনা, প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাস ও উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম আন্দোলনকারীদের দুইটি দাবি মেনে নিলেও ‘দুর্নীতির তদন্তে’ রাজি না হওয়ায় প্রথমে তার পদত্যাগ ও পরবর্তী সময়ে তার অপসারণ দাবি করে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। সেই ধারাবাহিকতায় গত দুইমাস ধরে উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আসছেন তারা।

ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে গেল ৪ নভেম্বর আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবরোধ শুরু করলে ৫ নভেম্বর শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালান। এই ঘটনার পর থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলো। ফলে সেশনজট আরও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কা শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জীববিজ্ঞান অনুষদের ফার্মেসি এবং পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগে দেড় বছরের, আইন অনুষদে এক বছরের, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে সরকার ও রাজনীতি বিভাগ ছাড়া বাকি পাচঁটি বিভাগে ছয় মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত, কলা ও মানবিকী অনুষদে বাংলা বিভাগ ছাড়া সবগুলো বিভাগে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত, গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, রসায়ন বিভাগ, ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগে এক বছর এবং পরিসংখ্যান ও গণিত বিভাগে ছয়মাস, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ ছাড়া প্রতিটি বিভাগে ছয়মাস থেকে একবছরের সেশনজট রয়েছে। অনুষদ ও বিভাগ ভেদে কোনো কোনো ব্যাচে সেশনজটের পরিমাণ আরও বেশি।

কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘২০১৯ শেষ হতে চললেও ২০১৮ সালের মাস্টার্স পরীক্ষা এখনো শুরু হয়নি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের বের হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে দেরি হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালেও পরীক্ষা শুরু করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সময় নিয়ে পরীক্ষাগুলোর তারিখ নির্ধারণ করা হবে। ফলে প্রায় একবছরের সেশনজট তো হয়েই গেছে। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সূত্র অধিকার নিউজ।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদ ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতার।

এ ব্যাপারে পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমাদের বিভাগে সেশনজট এক বছরের। এখনো শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারিনি। এখনতো মনে হচ্ছে পড়াশোনা শেষ করতে আরও সময় লাগবে। যে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট হচ্ছে সেটার দায়ভার কে নেবে?’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের বিভাগে আগে থেকেই দেড়বছরের সেশনজট রয়েছে। তার মধ্যে চলছে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ। এতে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হব আমরা। শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা, নিয়মানুযায়ী ক্লাস না নেওয়া ইত্যাদি কারণে ক্যাম্পাস খোলা থাকলেও সেশনজট বেড়েছে আর এভাবে যদি অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকে তাহলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। আশাকরি কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ ও উপ-উপাচার্য নুরুল আলমের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি।

প্রক্টর অধ্যাপক ফিরোজ-উল-হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে ক্লাস না হলে সেশনজট তো হবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হয়েছে। এই বন্ধের কারণে এর প্রভাব শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর পড়বেই। তবে আমরা চেষ্টা করব যেন বন্ধটা খুব বেশি দীর্ঘায়িত না হয়।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + one =

Back to top button