ভ্রমন

বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ বান্দরবানের তিন্দু

তিন্দু বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় অবস্থিত। তিন্দুকে বলা হয় বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ। পাহাড়ী সাঙ্গু নদী বয়ে গেছে তিন্দুর পাশ দিয়ে। এখানে পাহাড়, মেঘ, নদী, ঝর্ণা, রহস্য ও রোমাঞ্চ সব কিছুই একসাথে পাওয়া যায় বলে তিন্দু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণকারীদের কাছে অন্যতম আকর্ষনের নাম।

এখানে শক্ত কঠিন পাথরকে সারাক্ষণই বুকে নিয়ে বয়ে চলছে শঙ্খ নদীর স্বচ্ছ পানির ঢল। এখানে পাহাড়গলা পানিতে গা ডুবিয়ে সময়ে কাটিয়ে দিতে পারবেন নতুন নতুন মাছের সঙ্গে সারা দিন আড্ডা দিয়ে। স্থানীয় আদিবাসী মানুষের সারল্য ও আতিথিয়তায় মুগ্ধ হবেন অবশ্যই। সকাল বিকেল পাহাড় ঘিরে থাকে মেঘের ভাঁজে। মেঘমেলা দেখতে দেখতে কখন যে সময় কেটে যাবে তা টের পাবেন না ঘুণাক্ষরে। তিন্দুর অসাধারণত্ব বলে শেষ করা যাবে না।

এডভেঞ্চার প্রেমী পর্যটকদের কাছে অঞ্চলটি তার ভিন্ন মাত্রিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বেশ পরিচিত। আর তাই আপনি যদি এডভেঞ্চার প্রিয় হয়ে থাকেন তাহলে দেশের ভিতরেই এই অনবদ্য এডভেঞ্চার এর সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না। এছাড়া বর্তমানে নাফাখুম ঝর্ণা এডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় জায়গা। নাফাখুম যাওয়া বা আসার পথে তিন্দু ঘুরে দেখতে পারবেন বা চাইলে থাকতেও পারবেন।

 

কখন যাবেন
বছরের যে কোন সময়ই তিন্দুতে যেতে পারবেন। একেক সময়ে একেক রূপে ধরা দিবে তিন্দু ও তার চারপাশ। বর্ষাকালে গেলে উত্তাল সাঙ্গুর রূপ ও মেঘের আনাগোনা বেশি পাবেন যেমন তেমনই শীতকালে গেলে শঙ্খ নদীর চারপাশ ঘিরে জমাট বাঁধা মেঘ আর কুয়াশার রূপ দেখে মুগ্ধ হবেন।

তিন্দু যাবার উপায়
তিন্দু যেতে আপনাকে বান্দরবান জেলা সদরেই আসতে হবে প্রথম। তারপর বান্দরবান থেকে থানচি, থানচি থেকে নৌকায় সাঙ্গু নদী ধরে তিন্দু বাজার যেতে হবে।

ঢাকা থেকে বান্দরবান
ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এস. আলম, ইউনিক, হানিফ, শ্যামলি, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন ইত্যাদি পরিবহনের বাস বান্দারবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি এসব বাসের ভাড়া যথাক্রমে নন এসি ৫৫০-৬৫০ টাকা ও এসি ৯৫০-১৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্রগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বান্দরবান যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে প্রতিদিনই সোনার বাংলা, সুবর্ণ, মহানগর ইত্যাদি ট্রেন চটগ্রাম যায়। শ্রেনী ভেদে ভাড়া ৩২০-১৫০০ টাকা।

বান্দরবান থেকে থানচি
বান্দরবান থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭৯ কিলোমিটার। বান্দরবান থেকে থানচি যাওয়া যায় দুইভাবে; বাসে কিংবা রিজার্ভ জীপে। বান্দরবানের থানচি বাস স্ট্যান্ড থেকে এক ঘণ্টা পর পর লোকাল বাস থানচির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি বাস ভাড়া ২০০ টাকা, সময় লাগবে ৪-৫ ঘন্টা। রিজার্ভ জীপ/চান্দের গাড়িতে গেলে খরচ হবে ৫,৫০০-৬,০০০ টাকা, সময় লাগবে ৩-৩.৫ ঘন্টা। এক গাড়িতে ১২-১৪ জন অনায়াসে যাওয়া যায়। থানচি যাওয়ার সময় পথে পরবে মিলনছড়ি, চিম্বুক ও নীলগিরি। চারপাশের অপুর্ব ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে দীর্ঘ পাহাড়ি পথের এই ভ্রমণ আপনার চোখ ও মনকে সতেজ করে রাখবে।

থানচি থেকে তিন্দু

থানচি পৌঁছে আপনাকে অবশ্যই একজন গাইড ঠিক করতে হবে। গাইড ছাড়া তিন্দু ভ্রমণে যেতে পারবেন না। উপজেলা প্রসাশন থেকে অনুমতি পাওয়া যে কাউকে গাইড হিসেবে নিতে পারবেন। একরাত থাকলে গাইড ফি ১৫০০ টাক। আর যদি দিনে গিয়ে সেইদিনই ফিরে আসেন তাহলে গাইড ফি ৮০০ টাকা। গাইড ঠিক করার ব্যাপারটা আপনি থানচি গিয়েও করতে পারবেন অথবা আগে থেকে পরিচিত কোন গাইডকে কথা বলে ঠিক করে রাখতে পারেন। গাইড ঠিক করার পর আপনাকে থানচি বিজিবি ক্যাম্প/থানা থেকে অনুমতি নিতে হবে। ভ্রমণকারী সকল সদস্যের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, কোথায় যাবে, কয়দিন থাকবে এইসব তথ্য কাগজে লিখে জমা দিতে হবে। আর এইসব কাজে আপনার গাইড সাহায্য করবে।

অনুমতি পাওয়ার পর থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করতে হবে। এক নৌকায় ৪-৫ জন যেতে পারবেন। তিন্দু পর্যন্ত ইঞ্জিন নৌকা রিজার্ভ যাওয়া ও পরদিন আসা সহ ভাড়া ৩,০০০-৩,৫০০ টাকা। আর যদি রাতে না থেকে সেইদিনই ফিরে আসেন তাহলে নৌকা ভাড়া যাওয়া ও আসা ২,০০০-২,২০০ টাকা। থানচি থেকে নৌকায় তিন্দু যেতে সময় লাগবে দুই ঘন্টার মত। সাঙ্গুতে পানি কম থাকলে কিছু জায়গায় নৌকা থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে তখন সময় একটু বেশি লাগতে পারে। যাবার পথে সাঙ্গু নদীর রূপ আপনাকে বিমোহিত করে রাখবে।

থাকার ব্যবস্থা ও খাওয়া
তিন্দুতে থাকার ব্যবস্থা বলতে গেলে আদিবাসীদের বাঁশ-কাঠের মাচাং ঘর এবং সেখানের ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বারের তৈরী বাংলোতে। আর ইচ্ছে করলে তাবু নিয়ে ক্যাম্পিং করেও রাত কাটাতে পারেন। সেখানের আদিবাসী ঘর গুলো বেশ গুছানো এবং অতিথিপরায়ণ। খাওয়ার জন্যে তেমন কোন হোটেল নেই তবে আপনি যেখানে থাকবেন তারাই রেঁধে দিবে। চাইলে থানচি থেকে বাজার করে নিয়ে আসতে পারেন সাথে করে, তারপর নিজেরা রান্নার আয়োজন করতে পারবেন। আদিবাসী ঘর গুলোতে প্রতিদিন থাকার খরচ জনপ্রতি ১৫০ টাকা এবং প্রতিবেলা খেতে আপনার খরচ হবে ১০০-১৫০ টাকা। শঙ্খ নদীর তাজা মাছ কিংবা পাহাড়ী মুরগি, ডাল ও আলুভর্তা দিয়ে খেতে পারবেন।

আশেপাশে আর কি দেখবেন

তিন্দু বাজারের কাছেই রয়েছে কুমারী ঝর্ণা। বর্ষাকালে পূর্ণ যৌবনে থাকে এই কুমারী ঝর্ণা। তিন্দু বাজার থেকে নদী পার হয়ে কুমারী ঝর্ণায় যেতে লাগবে ১০-২০ মিনিট। তিন্দুর কাছেই রাজা পাথর ও বড় পাথর এলাকা। তিন্দু থেকে নদীর উজানে মিনিট বিশেক গেলেই দেখা মিলতে থাকবে বিশাল বিশাল পাথরের। বিশাল বিশাল সাইজের পাথরের কারণেই এই জায়গা বড় পাথর নামে পরিচিত। তিন্দুর এই বড় বড় পাথরের রাজ্যের সৌন্দর্য আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করবে। এখানে শুধু পাথর আর পাথর। নানা আকৃতির পাথরের ফাঁক গলে এগিয়ে চলে নৌকা। বড় পাথর এলাকা পার হয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক নৌ পথ দূরত্বে আছে রেমাক্রি। চাইলে সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন।

ভ্রমণ সতর্কতা ও টিপস

তিন্দুতে বিজিবি ক্যাম্প আছে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে কোন সমস্যা নাই।

থানচি থেকে তিন্দু যেতে হবে পানি পথে তাই শীতকাল ছাড়া অন্য সময় যাতায়াতে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখবেন।

যাওয়ার আগে থানচি থেকে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে যাবেন। সাথে করে নিজের আইডি কার্ড বা তার ফটোকপি রাখবেন।

তিন্দুতে সব মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করেনা। কিছু জায়গায় রবি ও এয়ারটেল তুলনামূলক ভাল কাজ করে।
তিন্দুতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা বলতে সোলার সিস্টেম। তাই সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাওয়া ভালো।

সাঙ্গু নদীতে পানির স্রোত অনেক, গোসল করতে গেলে অবশ্যই সেই ব্যাপারে সাবধান থাকবেন।

আপনার বা আপনার ভ্রমণ সঙ্গীদের মাধ্যমে পরিবেশ ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।

স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের সাথে অশালীন আচরণ করবেন না।

বিনা অনুমতিতে ছবি তোলা, ভিডিও করা বা এমন কিছু করবেন না যেন তারা বিব্রত হয়।

সূত্রঃ ভ্রমণ গাইড

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + eighteen =

Back to top button