মড়ার উপর আর কত খাঁড়ার ঘা?
শেষ পর্যন্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়লই, ঠেকানো গেল না। ভোক্তাদের অনুরোধ, উপরোধ, আবেদন, নিবেদন সব কিছু উপেক্ষা করে সরকার নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর হবে চলতি জানুয়ারি মাস থেকেই। এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সেটি কার্যকর হয় ডিসেম্বরে। তখন থেকেই বিদ্যুতের খুচরা মূল্য তথা গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে বিইআরসি গণশুনানি করে ৮ জানুয়ারি। বলা হয়েছিল, শুনানি-পরবর্তী মতামত জানাতে হবে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে, তারপর বিইআরসি নতুন দাম ঘোষণা করবে। কিন্তু সরকার সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না, তার আগেই গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়িয়ে দিল।
দেশের অর্থনীতি যখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণ যখন দিশেহারা, সে সময় বিদ্যুতের আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বললে কমই বলা হয়। সরকার বিদ্যুতের খুচরা মূল্যবৃদ্ধির জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন? বিইআরসির সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্যও অপেক্ষা করতে পারল না, নির্বাহী আদেশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে দাম বাড়াল। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণের জন্যই এ তাড়াহুড়া।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য এখন কী অবস্থায় আছে তা ভুক্তভোগী সবাই জানেন। এমন কোনো নিত্যপণ্য বা সেবা খাত নেই যার দাম বাড়েনি। ইতোমধ্যেই দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার ওএমএস (খোলাবাজারে বিক্রি) চালু করেছে। সেখানে অপেক্ষাকৃত কম দামে খাদ্যশস্য বিক্রি হয়। ওএমএস ট্রাকের পেছনে মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও বহু লোক প্রয়োজনীয় পণ্য না পেয়ে ফিরে যান। দ্রব্যমূল্যের চাপে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় অবস্থায় রয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর ফলে জনগণের জীবনযাত্রার সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতেও আতঙ্ক হয়। দেশের ব্যবসায়ী মহল, শিল্পোদ্যোক্তা ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মানুষের জীবনযাত্রায় দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
চলতি শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। সারা দেশ ছিল লোডশেডিংয়ের কবলে। শীতের শুরু থেকে লোডশেডিং বন্ধ হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও শিল্পকারখানার মালিকরা অভিযোগ করছেন, পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না করে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সব ধরনের পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়বে, বিক্রয়মূল্যও বাড়বে, চাপটা গিয়ে পড়বে ভোক্তাদের ওপর।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলে থাকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যা খরচ হয়, বিক্রয়মূল্য তার চেয়ে কম। উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য সমান সমান রাখার জন্য সরকারকে এ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়। ভর্তুকির পরিমাণ কমানোর জন্যই বিক্রয় মূল্য বাড়াতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ও বিক্রয় থেকে আয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, এটা ঠিক। তবে বিদ্যুৎ খাতে লোকসানের আসল কারণ খতিয়ে দেখা দরকার।
বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা তথা দুর্নীতির কথা অস্বীকার করা যায় না। সিস্টেম লস লোকসানের একটা বড় কারণ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা সঞ্চালন, বিতরণ ও সরবরাহের সময় এ সিস্টেম লস হয়। অর্থাৎ উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরোটা সরবরাহ হয় না অপচয়ের কারণে। কারিগরি কারণে যে অপচয় হয়, তা বন্ধ করা সম্ভব কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত বিদ্যুৎ চুরিও হয়, যা সিস্টেম লস হিসাবে দেখানো হয়।
বিদ্যুৎ খাতে বড় দুর্নীতিই হচ্ছে উৎপাদিত বিদ্যুৎ চুরি। অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুরি করা হয়। এ চুরির সঙ্গে যুক্ত আছে বিদ্যুৎ বিভাগের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। টাকার বিনিময়ে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দেওয়া এবং মিটারে কারচুপি এক সময়ে ব্যাপকভাবে হতো। মিটার রিডিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নের পর মিটার কারচুপি কমেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি। কারণ আধুনিক মিটার রিডিং ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র স্থাপন করা যায়নি। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ বিভাগকে বিপুল পরিমাণ লোকসান দিতে হচ্ছে। আর এ লোকসানের মাশুল দিতে হচ্ছে বিদ্যুতের গ্রাহকদের। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম।
গত ১৪ বছরে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে দশবার। এখন খুচরা পর্যায়ে ১১ বারের মতো দাম বাড়ানো হলো। এতদিন বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বা পুনর্নির্ধারণের আগে গণশুনানির মাধ্যমে ভোক্তাদের মতামত শুনত এবং মতামত বিবেচনায় নিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হতো। শুনানির পর ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিদ্যুতের দাম ঘোষণার বাধ্যবাধকতা আছে। শুনানি-পরবর্তী মতামত জানানোর জন্য এবার ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকার সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে নির্বাহী আদেশেই দাম বাড়িয়ে দিল। বিইআরসির মতো সংস্থার কোনো গুরুত্বই আর থাকছে না।
বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও সরকার রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা ভাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রেখেছে। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদিত না হলেও বৈদেশিক মুদ্রায় ভাড়া দিয়ে যেতে হয়। এর ফলে বিপুল পরিমাণ লোকসান হয়, যার মাশুল দিতে হয় ভোক্তাদের। লোকসান হওয়া সত্ত্বেও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন রাখতে হবে তার সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না সরকারের কাছ থেকে।
বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ৫ শতাংশ বাড়ানোর পর বলা হয়েছে, এরপর প্রতি মাসে মূল্য সমন্বয় করা হবে। এর মানেটা কী? তাহলে কি এখন থেকেই প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে? মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আর কতবার পড়বে?
বিদ্যুতের খুচরা মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি স্থগিত রাখা ও পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, জনজীবনে বিরাজমান দুর্ভোগের বিষয়ে সহানুভূতিশীল মনোভাব নিয়ে জনগণের পাশে থাকাই এ মুহূর্তে সরকারের কর্তব্য।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
সূত্রঃ যুগান্তর