মামলা চলার মধ্যেই শিশুকে নিয়ে বাবার দেশত্যাগ, দাদাকে তলব
জিম্মা সংক্রান্ত রিট মামলা বিচারাধীন রেখে তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে এক ব্যক্তি বিদেশ চলে যাওয়ার পর শিশুটির দাদার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাকে তলব করেছে হাই কোর্ট।
নাতিকে নিয়ে ছেলে শানিউর টি আই এম নবীর দেশত্যাগের পর ‘নিখোঁজ’ উল্লেখ করে থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা এবং আদালতের আদেশ নিয়ে ফেইসবুকে বিরূপ মন্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে টি আই এম নূরুন নবীকে (৭০) তলব করা হয়েছে।
সেই সাথে তার ছেলে শানিউর নবীর বাংলাদেশি পাসপোর্টের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে হাই কোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার রুলসহ এ আদেশ দেয়।
আদালতে হাজির করার আদেশ থাকার পর শিশু সন্তানকে নিয়ে দেশত্যাগ করায় শানিউর নবীর বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না, জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
আদালতে শিশুটির মা ভারতীয় নাগরিক সাদিকা শেখের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ও আইনজীবী কাজী মারুফুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
মারুফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আদালত এ বিষয়ে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার কাছেও লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে। এছাড়া গুলশান থানায় গত ১৭ নভেম্বর শিশুটির দাদা টি আই এম নবীর করা জিডি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে গুলশান থানার পুলিশকে।
যেভাবে সন্তান নিয়ে দেশত্যাগ
এর আগে গত ২৬ আগস্ট হাই কোর্ট ভারতীয় নাগরিক সাদিকা শেখ এবং বাংলাদেশি শানিউর নবীর তিন বছরের শিশুর জিম্মা নিয়ে আদেশ দিয়েছিল।
দুই মাস সময়সীমার ওই আদেশে বলা হয়, মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভোলপমেন্টের (ফ্লাড) ব্যবস্থাপনায় থাকবে মা ও শিশু। তবে বাবা সপ্তাহে তিন দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। এ দুই মাস সাদিকা শেখ পাসপোর্ট গুলশান থানায় জমা থাকবে।
তবে হাই কোর্টের আদেশের পর শিশুটির বাবা শানিউর নবী সন্তানকে গুলশানে উন্নত পরিবেশে রাখার ইচ্ছার কথা জানান। তখন শিশুটির মা সাদিকা শেখও রাজি হন।
উভয় পক্ষের সমঝোতায় সাদিকা শেখ ও তার শিশু সন্তানকে গুলশান ক্লাবে থাকার ব্যবস্থা করেন শানিউর নবী। এভাবেই গুলশান ক্লাবের ওই রুমে সন্তানকে নিয়ে থেকে আসছিলেন সাদিকা শেখ।
দুই সপ্তাহ পর গত ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গুলশান ক্লাবের ওই রুমটি তল্লাশিতে গিয়েছিল। তখন শানিউরের বাবাও ছিলেন। সাদিকা শেখের কাছে খবর পেয়ে তার আইনজীবীরা সেখানে গেলে গুলশান ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের ঢুকতে দেয়নি।
এদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশ মতো শিশুটিকে পৌঁছে দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলে শিশুটির মা সাদিকা শেখের আইনজীবী শানিউর নবীকে ফোন করলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার নম্বর পাঠিয়ে দেন।
তখন আইনজীবী মারুফুল আলম যোগাযোগ করলে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তাকে বলেন, শিশুটিকে তারা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবেন না, কারণ গুলশান ক্লাবের যে কক্ষে সাদিকা শেখ ও শিশুটির থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেই কক্ষে একটি ডিভাইস পাওয়া গেছে।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান ১৫ নভেম্বর শিশুটিকে আদালতে হাজির করা হবে।
আইনজীবী মারুফুল আলম ও আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মধ্যে এ কথোপকথনের রেকর্ড থাকার কথা এবং পুরো ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে একটি আবেদনে।
এদিকে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আদালতের ২৬ অগাস্ট দেওয়া আদেশের পরিমার্জন চেয়ে আবেদন করেন, যে আবেদনে বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন গল্প বলা হয়েছে বলে ওই আবেদনে উল্লেখ করেন সাদিকা শেখের আইনজীবী কাজী মারুফুল আলম।
কিন্তু ১৫ নভেম্বর শিশুটিকে আদালতে হাজির করা না হলে আদালত মৌখিক আদেশে ১৬ নভেম্বর বেলা ১০টার মধ্যে শিশুটিকে তার মায়ের আইনজীবী ফাওজিয়া করিমের সুপ্রিম কোর্টের চেম্বারে নিয়ে আসতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ আদেশের পরও শানিউর নবী শিশুটিকে নিয়ে আসেনি এবং এ বিষয়ে কোনো যোগাযোগ করেননি। ১৬ নভেম্বর বিকেলে বিষয়টি আদালতে ফের শুনানির জন্য উঠলে আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া আদালতকে বলেন, তিনি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি তার মক্কেলের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাকে তিনি পাননি।
তখন আদালত ফের অদেশ দেয়। শানিউর নবী যাতে শিশুটিকে নিয়ে দেশত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ১৭ নভেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য রাখে। সেই সাথে গুলশান থানার ওসিকে নির্দেশ দেয় শিশুসহ শানিউর নবীকে আদালতে হাজির করতে।
এদিকে শানিউর নবীর বাবা নূরুন নবী গত ১৭ নভেম্বর গুলশান থানায় ছেলে ও নাতি নিখোঁজ উল্লেখ করে সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন।
জিডিতে যা বলা হয়
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চের ১৬ নভেম্বরের আদেশের কথা উল্লেখ করে নূরুন নবী জিডিতে বলেন, “আমার ছেলে শানিউর টি আই এম নবী (৪০) তার ছেলে সাদিক নবী (৩ বছর ৭ মাস) কে বিজ্ঞ আদালতে সকাল ১০ ঘটিকায় হাজির করে তার বিপক্ষের আইনজীবীর নিকট বুঝিয়ে দিয়ে উক্ত মামলার শুনানিতে অংশ গ্রহণের কথা ছিল। সেই জন্য গত ১৫ নভেম্বর রাতে পারিবারিকভাবে আমার ছেলেকে যথাসময়ে তার ছেলেকে নিয়ে আদালতে হাজির হওয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনাকালে সে যথা সময়ে আদালতে হাজির হবে বলে আমাদের জানায়। এই সময় তাকে খুব বিষণ্ন এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।”
জিডিতে বলা হয়েছে, “১৬ নভেম্বর সকাল ৮টার দিকে আমার ছেলে তার ছেলেকে নিয়ে হাই কোর্টের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমি ও আমার মেয়ে ড. নাবীলা নবী বেলা আনুমানিক সোয়া ৯টায় হাই কোর্টের উদ্দেশে বাসা থেকে রওনা দিই এবং বেলা সোয়া ১০টায় হাই কোর্ট চত্বরে হাজির হই এবং আমার ছেলের আইনজীবী নিকট যাই। তখন আমি আমার ছেলে শানিউর এবং তার ছেলেকে হাই কোর্ট এলাকায় খোঁজাখুঁজি করি এবং উকিলের চেম্বারে না পেয়ে তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। আমি এবং আমার মেয়ে তাকে ফোনে যোগযোগ করার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাই।
“আমি এবং আমার মেয়ে বেলা ৩টা পর্যন্ত কোর্টে অবস্থান করে তাকে এবং তার ছেলেকে না পেয়ে আমার ছেলের আইনজীবীর সাথে কথা বলে বাসায় চলে আসি।”
নূরুন নবী জিডিতে বলেছেন, “এখনও তার ব্যবহৃত ফোন নম্বর বন্ধ পাচ্ছি। আমি একজন বয়স্ক ব্যক্তি, হার্ট এবং ব্লাড প্রেশারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। আমার ছেলে ও নাতিকে খুজে না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমি খুব ভয়ে আছি। একটি সন্ত্রাসী মহল আমার ছেলে শানিউর নবীকে পূর্ব থেকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করে আসছিল।”
এরপর ১৭ নভম্বের আদালত ফের আদেশ দেয়। তাতে পুলিশের ঢাকা মহানগর কমিশনার ও গুলশান থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়, শিশুসহ শানিউর নবীকে ২১ নভেম্বর বিকাল ৩টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে।
কিন্তু রোববার পুলিশ জানায়, শিশুটিকে নিয়ে বাবা শানিউর নবী দেশত্যাগ করেছেন। তখন আদালত মঙ্গলবার আদেশের জন্য রাখে।
আদেশের পর পুলিশের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আইনজীবী মারুফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শানিউর নবী শিশুটিকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে গেছেন বলে জানতে পেরেছি।”
ঘটনার পূর্বাপর
২০১৭ সালে ৪ জুলাই ভারতের হায়দ্রাবাদে সেদেশের মেয়ে সাদিকা শেখের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সামিউর নবীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাস শুরু করেন। পরে ব্যবসায়িক কারণে তারা ঢাকায় চলে আসেন।
২০১৮ সালে এই দম্পতির ঘরে এক ছেলে সন্তানের জন্ম হলেও এক পর্যায়ে তাদের দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। বনিবনা না হওয়ায় গত ১১ অগাস্ট সাদিকা শেখকে বিচ্ছেদের নোটিস পাঠান শানিউর। তখন সাদিকা বারিধারায় শানিউরের বাড়িতেই ছিলেন।
বিচ্ছেদের নোটিস পাঠানোর পর শানিউর সন্তানকে নিজ হেফাজতে রাখতে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন।অন্যদিকে সাদিকা নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন শানিউর নবীর বিরুদ্ধে। সাদিকার স্বজনরা তখন মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্লাড) কাছে আইনি সহায়তা চান।
এর ধারাবাহিকতায় শিশু ও তার মাকে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিত করতে হাই কোর্টে রিট আবেদন করা হয়। ফ্লাডের পরিচালক কাজী মারুফুল আলম ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ওই আবেদন করেন।
তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৯ অগাস্ট হাই কোর্ট বাংলাদেশে অবস্থান করা ভারতীয় নাগরিক সাদিকা শেখ ও তার শিশুসন্তানকে ২৬ আগস্ট আদালতে হাজির করতে গুলশান থানা-পুলিশকে নির্দেশ দেয়।
সে আদেশ অনুযায়ী শিশুসহ সাদেকা শেখ আদালতে হাজির হন। এরপর আদালত শিশুর মা-বাবার বক্তব্য শোনে। এরপর ফ্লাডের ব্যবস্থাপনায় মা-শিশুকে রাখার আদেশ দেয়।