আইন ও বিচারনগরজীবন

মালিবাগে টাকার জন্য বেঁধে রাখা হলো করোনায় মৃত লাশের হাত

করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর ওই রোগীকে ‘কথিত’ আইসিইউতে নেওয়া হয়। এরপর ক্রমাগত টাকার চাপ দেওয়া হয় রোগীর পরিবারকে।

রোগী মারা যান, মৃত্যুর পরেও বেডের সঙ্গে মৃতের হাত বাঁধা ছিল। এমনই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মালিবাগের প্রশান্তি হাসপাতালে।

করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তা ডা. মহিন উদ্দীন পারভেজ।

রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, অনেকটা সুস্থ থাকার পরও ১৪ জুন ভর্তি হওয়ার পরই তাকে প্রায় জোর করেই আইসিইউতে পাঠিয়ে দেন আইসিইউ কনসালটেন্ট ডা. এস এম আলীম।

১৮ জুন ভোরে মারা যান মহিন উদ্দীন পারভেজ। স্বজনদের কাছে ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় রোগীর স্বজন রুবেলের মোবাইল কেড়ে নেন ডা. আলীমের ম্যানেজার সাইফুল। তাকে এক রুমে আটকে রাখা হয়। বলা হয়, টাকা না দিলে তাকে র‌্যাবে দেওয়া হবে। তার ভাইয়ের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দিয়ে দেওয়া হবে। পরে রুবেল তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাসপাতাল খরচ ও প্রায় ৬০ হাজার টাকা ওষুধের দাম দিয়ে লাশ নিয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় ছাড়া পান।

প্রশান্তি হাসপাতালের মালিক ও আইসিইউ কনসালটেন্ট ডা. এস এম আলীম বলেন, রোগীকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন আমি সেখানে ছিলামই না। রুবেল যেসব কথা বলেছেন, তা মিথ্যা। তাকে পাগলের মতো মনে হয়েছে। তা ছাড়া আমরা এই হাসপাতালে করোনার কোনো রোগী ভর্তি করাই না। শ্বাসকষ্ট হলে ভর্তি করানো হয়। পরে এক পর্যায়ে অবশ্য তিনি বলেন, করোনার প্রাথমিক উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ভর্তি করাই। সিরিয়াস হলে করানো হয় না। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল থেকে করোনা রোগী হিসেবেই এখানে নিয়ে আসা হয়-এমন প্রশ্নে ডা. আলীম বলেন, তারা বলেছে শ্বাসকষ্টের কথা। করোনা নয়। আমাকে মিথ্যা বলা হয়েছে।

পরে রাতে রোগীর ভাই জসিম উদ্দিন রুবেলকে ফোন দিলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, রোগী ভর্তির সময় ডা. আলীম ছিলেন, সিসিটিভির ফুটেজ দেখলেই বুঝতে পারবেন। আমার ভাই মারা গেছেন। আর মিথ্যা বলে লাভ কী? তাছাড়া তার ম্যানেজার সাইফুল আমাদের সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করেছেন তিনি নিজেই দেখেছেন। আমার ভাই যে করোনা রোগী ছিলেন, তারা যে ওষুধপত্র লিখে দিয়েছেন সেই স্লিপ আছে। সবই করোনার ওষুধ ছিল।

রুবেলের অভিযোগ, হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসক ডা. এস এম এ আলীম তাকে দোতলায় নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করান এবং বলেন, এটা করোনা রোগী। কাউকে জানালে সমস্যা হবে। আমরা এখানে চিকিৎসা দেব। তবে প্রতিদিন খরচ হবে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি। ভর্তির সময় ১০ হাজার টাকা দিলেও ভর্তির পরপরই ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। ডা. আলীমের ম্যানেজার সাইফুল বলেন, আগে টাকা দেন নইলে ভর্তি করাব না। রোগী নিয়ে যান। করোনা রোগী ঢাকায় কোথাও ভর্তি করাতে পারবেন না। পরে কোনো উপায় না পেয়ে ভর্তি করাই। ওই রাতে ভাইয়ের সঙ্গে আর আমাকে দেখা করতে দেয়নি। রাতেই ১৮ হাজার টাকা ওষুধ কিনে দিতে হয়।

তার অভিযোগ, পরের দিন যখন ভাইকে দোতলায় দেখতে যাই, দেখি এক রুমে চারজন। কোনো পার্টিশন নেই। আইসিইউর কোনো পরিবেশ নেই। ভাইয়াকে এক হাত বেঁধে রেখেছে। আর নল দিয়ে শুধু অক্সিজেন দিচ্ছে। ওই ওয়ার্ডে করোনা ছাড়াও অন্য রোগী ছিলেন। এটা করোনা ইউনিট ছিল না। হার্টের রোগীও ছিল। ভাইয়াকে নরমাল বেডে রেখে শুধু ক্যানোলা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়। ভর্তি হওয়ার পরই ভাই বারবার অজ্ঞান হয়ে যায়। ভাইয়ের প্রেসার নরমাল থাকলেও পরে ৩৬ এ চলে আসে। যা খাবার পাঠিয়েছি, কিছুই খাওয়ানো হয়নি। স্যুপ, ফলমূল কিছুই খাওয়ায়নি। এখানে করোনা চিকিৎসা গোপনে করেছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আইসিইউতে ঢোকানোর পর সেখান থেকে নাকি কেউ আর ফেরত আসেনি বলেও অনেকে জানিয়েছেন। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন রুবেল।

শুধু প্রশান্তি হাসপাতালেই নয়, রাজধানীতে এমন অনেক বেসরকারি হাসপাতালেই চলছে আইসিইউ বাণিজ্য। বিশেষ করে করোনা রোগীকে জোর করেই আইসিইউতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রোগীর স্বজনদের কাছে নেওয়া হয় বিপুল পরিমাণে অর্থ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে  রোগী ভর্তির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই সুযোগে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে সেবার নামে চলছে ভয়াবহ বাণিজ্য। সুস্থ মানুষকে করোনার ভয়  দেখিয়ে নেওয়া হচ্ছে আইসিইউতে। সেবা নিতে গিয়ে লাখ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ।

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × one =

Back to top button