করোনাভাইরাসজাতীয়

মে মাসেই লক্ষাধিক আক্রান্তের আশঙ্কা

করোনায় দেশের কত মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুর শিকার হতে পারেন, তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির আট জনস্বাস্থ্যবিদের সমন্বয়ে দুই ধাপে করা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংক্রমণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মে মাসে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। মৃত্যু হতে পারে আটশ’ থেকে এক হাজার জনের। তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে এক লাখে পৌঁছাতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের করা এই পূর্বাভাসটি গত ২১ এপ্রিল আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে উপস্থাপন করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। ওই বৈঠকে বলা হয়, চলমান লকডাউন অব্যাহত রাখলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। এই পরিস্থিতিতে প্রথম পর্যায়ে ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষের শরীরে করোনার সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তবে পরিস্থিতি খারাপ হলে সংক্রমণের মাত্রা ও মৃত্যু দ্বিগুণ হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জনস্বাস্থ্যবিদরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছিলেন। সেখানে তারা দুই ধাপে দুটি পর্যালোচনা দিয়েছিলেন। প্রথমটিতে তারা ধারণা দিয়েছিলেন, ওই সময়ে সংক্রমণের যে মাত্রা ছিল সেই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মে মাসে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। দ্বিতীয় ধাপে তারা বলেছিলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে সংক্রমণের মাত্রা বাড়বে এবং সেটি দ্বিগুণ হয়ে এক লাখে পৌঁছাতে পারে।

মহাপরিচালক আরও বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে লকডাউন সীমিত করা হয়েছে। গার্মেন্ট চালু করাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগের পর্যালোচনার হিসাব কাজে আসবে না। জনস্বাস্থ্যবিদরা নতুন করে আরেকটি পর্যালোচনার কাজ শুরু করেছেন।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন কিনা এমন প্রশ্নে ডা. আজাদ বলেন, আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিধি কম ছিল। বর্তমানে সেটি বেড়ে ৩১টি ল্যাবের মাধ্যমে দিনে ছয় হাজারের বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। যখন এক হাজার মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছিল, তখনও কিন্তু সংক্রমণের মাত্রা ১০ শতাংশ কিংবা তার কাছাকাছি ছিল। এখনও সে রকমই আছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগের পর্যালোচনা অনুযায়ী সংক্রমণ হবে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংক্রমণের হার কী হবে, সেটা দেখার পর হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি বোঝা যাবে।

লকডাউন শিথিল করা হলে সংক্রমণ আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেন ডা. আজাদ। লকডাউনের বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সরকারকে কোনো পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে মাসের পর মাস পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর রাখা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশও লকডাউন শিথিলের পথে হাঁটছে। কারণ লকডাউনের কারণে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। সবকিছু বিবেচনা করে লকডাউন কিছুটা শিথিলের কথা ভাবা হচ্ছে। লকডাউন শিথিল করা হলে পরিস্থিতি কী হতে পারে, সেটি নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করছে বলে জানান তিনি।

শিথিলে বিপদ বাড়বে : করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আট সদস্যের জনস্বাস্থ্যবিদকে নিয়ে কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কমিটির নেতৃত্বে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, আটটি বিভাগের আটজন জনস্বাস্থ্যবিদের সমন্বয়ে তারা করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। তারা প্রতিদিন করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন এবং সপ্তাহে একবার তা প্রতিবেদন আকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জমা দেন।

লকডাউন শিথিলের পর পরিস্থিতি কী হতে পারে- এমন প্রশ্নে অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, করোনা প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হলো সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং পরীক্ষা করা। যেসব দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, তারা এ পদ্ধতিটি পুরোপুরি মেনে চলেছে। আমরা সেটি পারিনি। বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলব, গার্মেন্ট, ফ্যাক্টরি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত খারাপ হয়েছে। কারণ হাজার হাজার কর্মীর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যালোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, চলতি মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হবে। অর্থাৎ মে মাসকে পিক টাইম হিসেবে বিবেচনা করছি। জুনের মাঝামাঝি সেটি কিছুটা কমে আসবে। তবে পৃথিবী থেকে ভাইরাসটি পুরোপুরি বিদায় করতে হলে কার্যকর ভ্যাকসিন লাগবে। অন্যথায় এটির সংক্রমণ কখনও সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না।

আইসোলেশন, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা বাড়ানোর তাগিদ : করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা নিয়ে ২১ এপ্রিলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বৈঠকে জনস্বাস্থ্যবিদদের করা পর্যালোচনা আমলে নিয়ে বেশকিছু কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র সমকালকে জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধে তিন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। প্রথমটি হলো, সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক আইসোলেশন শয্যা, ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউ বেড প্রস্তুত করতে হবে। তৃতীয়ত, আরও বেশি করে পরীক্ষা করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনা আক্রান্ত ২০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে রেখে সেবা দেওয়া প্রয়োজন। বাকি ৮০ শতাংশ বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারবেন। সভায় জানানো হয়, যে ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে, তাদের জন্য পর্যাপ্ত আইসিইউ, ভেন্টিলেটর এবং আইসোলেশন শয্যা নেই। এগুলো দ্রুত বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে সারাদেশে হাসপাতাল প্রস্তুত করার ব্যবস্থা নিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

প্রস্তুতি সন্তোষজনক নয় : করোনা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা সংক্রমণের রোগীদের চারটি স্তরে ভাগ করেছে। তাদের মধ্যে মৃদু, মধ্যপন্থি, গুরুতর এবং সংকটপূর্ণ। মে মাসের মধ্যে গুরুতর ও সংকটপূর্ণ রোগীদের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসার সুবিধা বাড়াতে হবে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সেগুলোতে এখনই শয্যা খালি নেই। এই স্বল্প সংখ্যক হাসপাতাল দিয়ে রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। আরও জোরালো প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করতে হবে।

চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, গত চার মাস ধরে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রস্তুতির কথা বলে আসছে। আসলে তারা কী প্রস্তুতি নিয়েছিল, সেটি বিস্তারিত জানানো উচিত। বক্তব্য দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তুতি তো চোখে পড়ছে না। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজারের কিছু বেশি আইসিইউ আছে। এটি তারা বাড়াতে পারত। প্রত্যেকটি জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ থেকে ৫০ শয্যার আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর বসানো যেত। হাসপাতালে যে রকম আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্ট প্রয়োজন হয়, সেটিই নেই। এ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলেও তো চিকিৎসা মিলবে না। সরকারকে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ফোকাল পারসন ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান বলেন, করোনা মোকাবিলায় সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক ও প্রায় ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে ৩০ হাজারের ওপরে আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিদিনই আইসোলেশন শয্যা বৃদ্ধির কাজ চলছে। করোনা চিকিৎসার জন্য নতুন নতুন ডেডিকেটেড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর মেশিন বসানো হচ্ছে। চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য প্রতিদিনই মানসম্পন্ন পিপিই ও মাস্ক সংগ্রহের কাজ চলছে। নমুনা পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিট সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও কিট আমদানির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সার্বিকভাবে প্রস্তুতি বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে বলে মনে করেন তিনি। সূত্র সমকাল

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 + two =

Back to top button