BreakingLead Newsআন্তর্জাতিকজাতীয়

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম অধিকার নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় দেশের রপ্তানিকারকেরা

পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন, এখনই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা শুরু করা উচিত।

বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের। বিশেষ করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, কোনো কারণে শ্রম অধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন নীতিটি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর করলে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এ দেশের রপ্তানি খাতে। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের করণীয়গুলো কেমন হবে, তা জানতে কূটনৈতিকভাবে আলোচনার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবন যাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, যাঁরা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাঁদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতি নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। যতটুকু বুঝতে পারছি তাতে মনে হচ্ছে, এ নীতি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও আরোপের সুযোগ রয়েছে।
এ কে আজাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হা-মীম গ্রুপ

শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে অস্থিরতা চলছে। শ্রমিকেরা আন্দোলনে নেমেছেন। আবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি কার্যকর করেছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন এ নীতি রপ্তানিকারকদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতির বিষয়ে জানাতে গিয়ে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা কল্পনা আক্তারের নামটিও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কল্পনা জানিয়েছেন, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পরামর্শকের ভূমিকা রেখেছে। এ জন্য তিনি (কল্পনা) এখনো বেঁচে আছেন।

গতকাল শনিবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশের জন্য। এটি কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।

তবে বাংলাদেশে শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয়ে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলেও জানান কল্পনা আক্তার। তিনি বলেন, আইনি বৈধতা থাকলেও শ্রমিক সংগঠন করতে গেলে শ্রমিকেরা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হন। শ্রম আইন অনুযায়ী অন্যায্য শ্রম চর্চার বিষয়ে কোনো মামলা করতে গেলে শ্রম অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতির কারণে যদি আমাদের মালিকপক্ষ ও সরকার শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও সচেতন হয়, তাহলে দেশের জন্যই তা মঙ্গলজনক।’

নতুন এ নীতির কারণে যদি আমাদের মালিকপক্ষ ও সরকার শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও সচেতন হয়, তাহলে দেশের জন্যই তা মঙ্গলজনক।
কল্পনা আক্তার, সভাপতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন

রপ্তানিকারকেরা যা বলছেন
শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির বিষয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো, এ দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মৎস্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৯৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যার মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৫১ কোটি ডলার।

তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতি নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। এখন পর্যন্ত আমরা বিষয়টি যতটুকু বুঝতে পারছি তাতে মনে হচ্ছে, এ নীতি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও আরোপের সুযোগ রয়েছে। তাই এখনই বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।’

বর্তমান সময়ের কারণেই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ

জানা যায়, গতকাল দিনভর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল পোশাকশিল্প মালিকদের মধ্যে। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একধরনের টানাপোড়েন চলছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে শ্রম ইস্যু। ফলে নতুন এ নীতি দেশটি কীভাবে কাদের ওপর কার্যকর করবে, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ বেশি। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরে দেশে শ্রমিক অসন্তোষ বিরাজ করছে।’

এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলতি বছর পোশাক রপ্তানি কিছুটা নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে অক্টোবর—এ চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ শতাংশের বেশি কমেছে।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণেই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বাংলাদেশের জন্য এ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন নীতিতে জোরপূর্বক শ্রমের বিষয়ে যেটি বলা হয়েছে, সে ধরনের পরিস্থিতি আমাদের নেই। তবু পুরো বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’

যখন কোনো দেশে কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, তখনই সেখানে বাইরের কেউ এসে কথা বলার সুযোগ পান।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, শ্রম কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ, আইএলও দক্ষিণ এশিয়া
নিজেদের দুর্বলতা নিজেদেরই দূর করতে হবে

পোশাকশিল্পের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার কিংবা পোশাকমালিকদের দিক থেকে যতই বলা হোক, এ দেশে শ্রমিকদের কথা বলার অধিকার আছে, শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে—যদিও বাস্তবতা ভিন্ন।

জানতে চাইলে বর্তমানে ভারতের দিল্লিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওতে কর্মরত সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার শ্রম কার্যক্রমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ (স্পেশালিস্ট অন ওয়ার্কার অ্যাকটিভিটিস) সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, যখন কোনো দেশে কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, তখনই সেখানে বাইরের কেউ এসে কথা বলার সুযোগ পান। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে নিজেদের দুর্বলতা নিজেদেরই দূর করতে হবে।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রমিকের অধিকারের বিষয়ে প্রকৃত শ্রমিক প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সেখানেই বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনকে যেভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে, তা বহির্বিশ্বে ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven − 1 =

Back to top button