বিচিত্র

যে কারণে রিকশায় কিস্তির জ্বালা লিখেছেন আনোয়ার!

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে চলাচলের সময় ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের কানাইপুর বাজার এলাকায় ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা চলাচল করে। রিকশাটি অন্য আর দশটির মতো হলেও আলোচনায় আছে একটি বিশেষ কারণে।

সেই কারণটি হলো রিকশার পেছনে একটি ডিজিটাল ব্যানারে লেখা রয়েছে, কিস্তির জ্বালা পরিবহন। আরও লেখা রয়েছে সকল প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য ৪০ শতাংশ ডিসকাউন্টের কথা। বি:দ্র: দিয়ে লেখা, শুধুমাত্র বেকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য। রিকশার পেছনে এমন লেখা দেখে বিস্তারিত জানার আগ্রহ তৈরি হয় যাত্রী ও পথচারীদের।

সেই আগ্রহ এবং রিকশার এই ব্যতিক্রমী নাম ও বেকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের রিকশায় চড়ায় ছাড় দেওয়ার বিষয় নিয়ে কথা হয় রিকশাটির মালিক শাহ্ মো. আনোয়ারের সঙ্গে। তিনি সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা আজমত প্রধানীয়ার ছেলে। |

৩৬ বছর বয়সী আনোয়ার জানান, চার বছর আগে রিকশাটি কিনলেও ব্যতিক্রমী ‘কিস্তির জ্বালা পরিবহন’ নাম দিয়েছেন দিন পনেরো আগে। রিকশার নামকরণ জানানোর আগে তিনি তার জীবনের এক গল্প শোনার অনুরোধ করেন এই প্রতিবেদককে।

আনোয়ার জানান, ২০০১ সালে তিনি ১৪ বছর বয়সী কিশোর। ওই সময় বেড়াতে যান মামা বাড়ি পাশের মধুখালির উপজেলা একটি গ্রামে। সেখানে বেড়াতে গিয়েই এক কিশোরীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে টুকটাক কথাবার্তা হতো। এরপর চলে চিঠি চালাচালি। এভাবেই এক পর্যায়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা।

আনোয়ার বলেন, তখনও আমরা একে অপরকে ভালোবাসি শব্দটি বলিনি। তবে ততদিনে আমরা বুঝে গিয়েছি সব কথা বলে বোঝাতে হয় না। আমরা নিজেরাই বুঝে নিয়েছি আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।

তিনি বলেন, তখনকার প্রেম এখনকার মতো ছিল না। এখন তো কথায় কথায় ছেলে-মেয়েদের প্রেম হয় আবার ভেঙেও যায়।
আমাদের দুজনের দেখা করার সুযোগ তেমন ছিল না। দেখা করতে ইচ্ছে হলেই আমি মামা বাড়িতে চলে যেতাম। সেখানেও খুব সহজে দেখা করা সম্ভব হতো না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা দেখা করতাম। আমাদের বেশিরভাগ সময় কথা হতো০ চিঠিতে। এভাবেই প্রেম চলছিল। ২০০৮ সালে এসে আমাদের প্রেম ভেঙে যায়। বেকার থাকায় প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারিনি। পরে তার অন্যখানে বিয়ে হয়ে যায়। তখন থেকে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা থেকে তিনি অনুধাবন করতে পারেন বেকার প্রেমিকদের কত সমস্যা, কত যন্ত্রণা কত জ্বালা।

আনোয়ার বলেন, বেকার জীবনের প্রেম কী, তা আমি ভালো জানি। প্রেমের সময় আমি আমার প্রেমিকার কাছ থেকেই বেশি উপহার নিয়েছি। আমাদের সকল স্মৃতি ডায়েরিতে লেখা আছে। তাকে মনের মতো কিছু দিতে পারিনি। কারণে আমার কাছে টাকা ছিল না। কারণ আমি বেকার ছিলাম। শুধু কয়েকটি লাল ও সাদা গোলাপের গাছ উপহার দিয়েছি তাকে।

সবাই তো প্রেমিকাকে ফুল দেয়, আপনি গাছ দিতেন কেন? আনোয়ার বলেন, ফুল তো এক সময় শুকিয়ে যায়। বেশি দিন টেকে না। এজন্য গাছ দিতাম। গাছে যখন প্রতি নিয়ত ফুল ফুটবে তখন সে আমার কথা মনে করবে। আমাকে নিয়ে ভাববে।

কতদিন প্রেম ছিল জানতে চাইলে, চমকে দেওয়ার মতো হিসাব দেয় আনোয়ার। গড় গড় করে বলে যান আমার প্রেমের স্থিতিকাল সাত বছর ১১ মাস ২১ দিন ৩১ মিনিট ২৩ সেকেন্ড।

তিনি বলেন, সে কথা দিয়েছিল আমাকে ছেড়ে যাবে না। এত বছর প্রেম করেও শুধুমাত্র বেকার হওয়ার কারণে আমার প্রেমকে আমি সফলতার পথে নিয়ে যেতে পারিনি। সেই থেকে বেকার প্রেমিকের কষ্ট আমি হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছি। এজন্যই সেই থেকে আমার চিন্তা ছিল বেকার প্রেমিকদের জন্য কিছু করার। নিজের সামর্থ্য কম। রিকশা চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় আমাকে। বিয়ে করেছি। সন্তান আছে। এ আয়েই সংসার চালাতে হয়। এর মধ্যে থেকে বেকার প্রেমিক প্রেমিকাদের ৪০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছি। একশ টাকার ভাড়া নিচ্ছি ৬০ টাকা।

২০০৩ সালে আনোয়ারের বাবা মারা যান। এর আগে তিনি অসুস্থ ছিলেন। সেখানে তার চিকিৎসায় অনেক অর্থ ব্যয় হয়। সম্পদ বলতে তখন তার বাবা খুব বেশি কিছু রেখে যেতে পারেননি। মা ও বাকি ভাইবোন নিয়ে চলে সংসার। ২০০৯ সালে একই উপজেলা ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুর গ্রামের ববিতা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। আনোয়ার-ববিতা দম্পতির সংসারে বর্তমানে ১১ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া আবদুল্লাহ বিন উদয় ও পাঁচ বছর বয়সী নার্সারি শ্রেণিতে পড়ুয়া আলহাজ বিন উজান নামে দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে।

রিকশার নাম যেকারণে ‘কিস্তির জ্বালা পরিবহন’
আনোয়ার বলেন, বর্তমানে আমার ৫০ ও ২০ হাজার টাকার দুটি ঋণ নেওয়া আছে। ৫০ হাজার ঋণের জন্য সপ্তাহে এক হাজার টাকা ও ২০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ৫০০ টাকা কিস্তি দিতে হয়।

একদিনের অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে আনোয়ার বলেন, একদিন সকালে কিস্তির টাকা বাড়িতে রেখে আসার মনে নাই। সেদিন কিস্তির লোক বাড়িতে এসে টাকা না পেয়ে বাড়ির নারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। সেই ভাবনা থেকেই আমার রিকশার নাম কিস্তির জ্বালা দিয়েছি। আর যাতে আমি ভুলে না যাই যে, সপ্তাহ গেলে আমাকে কিস্তির দেড় হাজার টাকা জোগাড় করতেই হবে।

বেকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের ৪০ শতাংশ ছাড়ের সুবিধা দেওয়ায় গত ১৫ দিনে তার আয় কেমন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ১৫ দিনে কয়েকদল প্রেমিক-প্রেমিকা আমার রিকশায় উঠেছে। তবে তারা কেউ টাকা কম দেয়নি। আমি তাদেরকে বলেছি তোমাদের আবারও ঘুরতে ইচ্ছে করলে টাকা না থাকলেও আমার রিকশায় আসবা। তোমাদের প্রেম যদি সফল হয় তাহলে বিয়ের একদিন আগে এসে আমার টাকা দিলেই হবে। আমার স্বস্তি এখানেই যে, ১০০ টাকার ভাড়ায় অন্তত ৪০ টাকা আমি ছাড় দিতে পারছি। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমি প্রেমিক-প্রেমিকাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আসলে আমি চাই সবার প্রেম সফল হোক।

নিজের সাত বছরের প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকে তার ভুল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আবেগে ভালোবেসেছিলাম। তখন আসলে বুঝি নাই আবেগে সংসার চলে না। সংসার চালাতে হলে কিছু করতে হয়, টাকা উপার্জন করতে হয়।

ব্যতিক্রমী এই নাম ও ছাড় দেওয়ায় তার স্ত্রী ববিতা বেগমের মনোভাব জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার স্বামীর প্রেমের ব্যাপারটা তার মুখ থেকে বিয়ের শুরুতেই আমি শুনেছি। তখন এসব নিয়ে টুকটাক ঝগড়া-ঝামেলা হতো। এখন আর এসব নিয়ে ঝামেলা তেমন একটা হয় না।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৪ বছরের সংসার জীবনে আমার স্বামীকে আমার প্রতি ভালোবাসা কম দেখাতে দেখিনি। আমার জন্য তিনি অনেক করেছেন। এখন আমাদের সংসারে দুইটা ছেলে সন্তান হয়েছে এদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবনটা ভালো মতো পার করতে পারলেই হয়।

নিজের প্রেমিকার স্মৃতি রোমন্থন করে আনোয়ার বলেন, এখনও কিছু বিশেষ বিশেষ দিনে তার কথা মনে পড়ে। ভালোবাসা দিবস, বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখে আমার মামা বাড়ির পাশে সাতদিনের জন্য মেলা হতো। প্রেম চলাকালীন ওই সাত বছর আমি ওই মেলা বাদ দিতাম না। কারণ, ওই মেলায় তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছিল সূবর্ণ সুযোগ। আজও তাকে ভুলতে পারিনি। ভালোবাসা তো এমনই। ভোলা যায় না আসলে।

বর্তমান প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রতি আনোয়ারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানের কিছু প্রেমের সম্পর্ক দেখি যা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। প্রেম তো একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা দেখানোর উপযুক্ত একটি ক্ষেত্র। পাশাপাশি শুধু প্রেমে ডুবে থাকলেও দুজনের একসঙ্গে থাকার পথ কঠিন হয়ে যাবে। প্রেমিক বেকার থাকলে প্রেমিকার বছরের পর বছরের ভালোবাসাও মিথ্যে হয়ে যাবে। বেকার ছেলের সঙ্গে কেউ থাকতে চাইবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × five =

Back to top button