মো. হেলাল উদ্দিন রাজধানী ঢাকার রামপুরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করেন। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির মিষ্টি বিক্রির শোরুমে চাকরি করছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশে দেখা দেওয়ার পর সরকার ঘোষিত সারা দেশে ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত লকডাউন কার্যকরভাবে পালন করা হয়।
সেই থেকে বন্ধ থাকে মিষ্টির শোরুম। একইসঙ্গে বেতন কমে যায় অর্ধেক। রমজানের ঈদেও বোনাস দেওয়া হয়নি। আগে কোম্পানি যে বেতন দিতেন সে টাকা দিয়ে বাসাভাড়া, সংসার খরচ ও ছেলেমেয়েদের খরচ কোনো রকম চলত।
কিন্তু বিগত দুই মাস বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনো মতে চলেছেন। এখন টাকার সংকুলান না হওয়ায় চলতি মাসের শুরুতে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে এখন ব্যাচেলর বাসায় উঠেছেন। এতে খালি হচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়ি। অলিগলিতে ও ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে ঝুলছে অনেক টু-লেট।
এ অবস্থা শুধু হাফিজ উদ্দিনেই নন, তার মতো অর্থ সংকটে আছেন রাজধানীবাসী হাজার হাজার মানুষ। গত তিন মাসের লোকসান সামলে উঠতে না পারায় তাদের কেউ সপরিবারে ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়ি, কেউ স্ত্রী-সন্তানকে পাঠিয়ে শুধু নিজে রয়ে গেছেন। প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছেন ঢাকা বা নগরীর উপকণ্ঠের বিভিন্ন এলাকার ভাড়া বাসা।
দেশের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হতেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসত মানুষ। এভাবে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় প্রায় ২ কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। এ ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর বাসার উচ্চ ভাড়া দিয়ে আসছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসাভাড়ার চিত্রও। করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, ফলে আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা ফলে ছেড়ে দিচ্ছেন বাসা, ছেড়ে দিচ্ছেন ঢাকাও।
করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, বেশির ভাগ বাড়িতেই দু-একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা আছে। ভাড়াটিয়া চেয়ে ‘টু-লেট’ লেখা বিজ্ঞাপন সাঁটানো থাকলেও বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছেন না। দু-একটি ফ্ল্যাট ফাঁকা হয়ে যাওয়ার মধ্যেই বাড়ির মালিককে বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন আরো অনেক ভাড়াটিয়া।
রাজধানীর বনশ্রী এলাকার একটি বাড়ির মালিক কামরান মিয়া বলেন, আমার পাঁচতলা বাড়ির দুটি ফ্ল্যাট গত দুই মাস ধরে ফাঁকা। আগে ‘টু-লেট’ সাঁটানোর সাত দিনের মধ্যে বাসাভাড়া হয়ে যেত। কিন্তু এখন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না।
আশপাশে আরো কিছু বাড়িতে এভাবে ‘টু-লেট’ ঝুলছিল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। অনেকে পরিবারকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কোনো মেসে উঠেছেন। অনেকের ইনকাম কমে গেছে, যে কারণে আগে ১৬ হাজার টাকার বাড়িতে থাকলেও এখন ১০ হাজার টাকা ভাড়ার বাসায় চলে যেতে চাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ঢাকা শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া থাকে। কিন্তু এই বিশাল ভাড়াটিয়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকারের কথা কোনো জনপ্রতিনিধিরা বলেন না এবং তাদের অধিকার রক্ষা করেন না। ভাড়াটিয়ারা নানাভাবে অধিকারবঞ্চিত। করোনা মহামারির প্রভাবে রাজধানীসহ সারা দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারের জন্য প্রতিদিনের খাবারের ব্যবস্থা করাই একটি চ্যালেঞ্জ, সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বাড়িভাড়া, গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল ও বিভিন্ন সার্ভিসের বিল।
তিনি আরো বলেন, আমরা শুনতে পেরেছি ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালাদের চাপে পড়ে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র খুবই কম দামে বিক্রি করে ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোথাও কোথাও জোরপূর্বক বাসা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। মানসিক নির্যাতনের তো কোনো সীমাই নেই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে মানবিক দিক বিবেচনা করে তিন মাসের ভাড়া মওকুফের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি।