রাতে জেগে থাকার ভয়ংকর পরিনতি
আল্লাহ তায়ালা রাতকে স্বস্তি ও বিশ্রামের স্থান এবং দিনকে আলোকিত ও কর্মমুখর করে বান্দার ওপর অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ঘুম-ই পারে দিনের কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা অর্জিত ক্লান্তি নিরসন করতে। আমরা সারা দিন যা শিখি তা ব্রেনে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ঘুম অপরিহার্য, ঘুমের মধ্যে স্মৃতির সমন্বয় প্রক্রিয়ায় স্থায়ীরূপ লাভ সহজ হয়।
আল্লাহর সৃষ্টি জগতবাসীর প্রকৃতি বা সাধারণ নিয়ম, এ নিয়মের বিরোধিতা মূলত প্রকৃতির বিরোধিতা, যার পরিণতি ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়। ঘুমের জন্য রাত, কাজের জন্য দিন নির্ধারিত, এর বিপরীত হলে শরীর, স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতা বিপর্যস্ত হয়।
আল্লাহ তায়ালা আসমান-জমিন, রাত-দিন যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছেন, কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি।
আল্লাহ বলেন ‘আল্লাহ যথার্থরূপে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। এতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য (আনকাবুত : ৪৪)। আমরা কুরআন থেকে দেখব, সৃষ্টিকর্তা রাত কেন বানিয়েছেন এবং রাত জাগার কুফল সম্পর্কে রব্বে কারিম বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য রাত বানিয়েছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম করতে পারো এবং দিনকে করেছেন আলোকোজ্জ্বল, নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না’ (সূরা গাফির : ৬১)।
রাসূল সা:-এর হাদিসে রয়েছে, ‘রাতের বেলা অন্যান্য কাজ উপেক্ষা করে ঘুমানো উত্তম।’ কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম কারণে-অকারণেই রাত জেগে থাকে, রাতে কেন ঘুমায় না এ প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশের উত্তর হবেÑ রাত জাগতে ভালো লাগে বা রাত জাগা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলে, তারা একেকজন নিজেকে রাতজাগা পাখি বলে দাবি করে থাকে।
কোনো প্রাণী লাগাতার নির্ঘুম থাকতে পারে না, যে কৃত্রিম উপায়ে জেগে থাকার চেষ্টা করবে, তার মৃত্যু নিশ্চিত। রাত জাগার ফলে সুন্নতের বিরোধিতা হয়। আবু বারজাহ রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: এশার আগে ঘুম ও পরে কথাবার্তা অপছন্দ করতেন (বুখারি- ৫৩৭, মুসলিম-১০৩২)।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে রাত জাগার শারীরিক ক্ষতি: যুক্তরাজ্যের স্লিপ রিসার্চ সেন্টারের গবেষকরা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখেছেন, রাত জেগে কাজের যে কুফল তা গভীরতর আণবিক স্তরে পরিলক্ষিত হয়। রাত জাগার ক্ষতির পরিমাণ আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়েছে এবং রাত জাগার ফলে হরমোন পরিবর্তন, দেহের তাপমাত্রায় রদবদল, মেজাজ ও মস্তিষ্কে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এ গবেষণা সংক্রান্ত নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ সাময়িকীতে।
বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, রাতের বেলায় কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের সাথে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকির সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। রাত জাগা ২২ ব্যক্তিকে নিয়ে তারা গবেষণা করে শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো খেয়াল করেন। তাদের দাবি, রাতে যারা জেগে থাকেন
১. তাদের মধ্যে বিষন্নতা, বিরক্তি : হ্যালুসিনেশনসহ নানাবিধ মানসিক রোগের বা উপসর্গের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়, এমনকি প্রস্টেট ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন রাতজাগা নারী-পুরুষরা। যারা রাতে ঠিকমতো ঘুমান না তাদের মাইগ্রেনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, মস্তিষ্কের টিস্যু নষ্ট হওয়া শুরু হয়।
২.স্মৃতিশক্তি কমে যায় : গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন যেসব কিশোর-কিশোরী রাতে ৫ ঘণ্টার কম ঘুমায় তাদের যারা রাতে ৮ ঘণ্টা ঘুমায় এমন কিশোর-কিশোরীদের তুলনায় বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৭১ শতাংশ বেশি এবং আত্মহত্যার চিন্তা ৪৮ শতাংশ বেশি। রাত ১০টার পরে ঘুমালে আত্মহত্যার সম্ভাবনা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায় এমনকি ৮ ঘণ্টা ঘুমালেও।
৩. সাধারণ মানুষের তুলনায় রাতজাগা মানুষের হৃৎপিণ্ডের অসুখ-বিসুখের ঝুঁকি প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। ওয়ারউইক মেডিক্যাল স্কুলের গবেষকরা বলেছেন, ‘যদি আপনি রাতে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমান এবং ঘুম ঠিকমতো না হয় তাহলে আপনার হৃদরোগ হওয়ার বা তা থেকে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৪৮ শতাংশ বেশি এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া বা তা থেকে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ১৫ শতাংশ বেশি।’
৪. যারা রাত জাগেন তাদের মধ্যে বুক জ্বালাপোড়া করা, পেপটিক আলসার, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রোম (আইবিএস), ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্যসহ নানা রাতে জেগে থাকার ভয়াবহতা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অ্যাসিডিটির সমস্যা হওয়ার ফলে পরবর্তীতে তা পাকস্থলীর আলসারে রূপ নেয়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
মুমিনের রাত জাগরণে ভয়াবহতা : একজন মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য যেমন অপরিহার্য একইভাবে একজন মুমিন বান্দার জন্য খাদ্য গ্রহণের চেয়েও রব্বের ফরজকৃত সালাত কায়েম অপরিহার্য, শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া যেমন। বেঁচে থাকা যায় না একইভাবে সালাত আদায় ছাড়া মুমিন হিসেবে গণ্য করা হয় ।
যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দেয় সে মুমিনের তালিকা থেকে নিজের নাম মুছে ফেলে, মূলত হতভাগারা ছাড়া দুনিয়ার বুনকো কর্মব্যস্ততার জন্য কেউ আল্লাহর ফরজ করা বিধান ছেড়ে দিয়ে জাহান্নামে নিজের বাসস্থান তৈরি করে না। সালাত ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ, রাত জাগার ফলে বেশির ভাগ সময় ফজর সালাত জামাতের সাথে আদায় করা সম্ভব হয় না, যা (জামাত) পূর্ণ রাত ইবাদতের সমতুল্য।
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত : ‘যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত কিয়াম করল, আর যে এশা ও ফজর জামাতের সাথে আদায় করল, সে যেন পূর্ণৱাত কিয়াম করল।
রাত জাগার ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফজরের নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে,ফজর না আদায় করে ঘুমিয়ে থাকার ভয়াবহতা অত্যধিক, হাদিসে রয়েছে, “মৃত্যুর পর তাদের মাথা পাথর দিয়ে ভাঙা হবে, যারা ফজরের নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে ছিল’ (বুখারি : ৭০৪৭)।
বৈধ কাজে রাত জাগার পরিণতিও খারাপ। আর হারাম কাজে রাত জাগার পরিণতি আরাে মারাত্মক, আরাে ভয়ঙ্কর, যেমন খেল-তামাশা, অশ্লীল বিনােদন ও সিরিয়াল দর্শনে মত্ত থাকা- তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে : তার দেখা, তার শ্রবণ করা ও তার অন্তরের গােপন বিষয় সম্পর্কে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : “নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তঃকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে’
(সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩৬)।
“অতএব, তােমার রবের কসম, আমরা তাদের সবাইকে অবশ্যই জেরা করব, তারা যা করত, সে সম্পর্কে’ (সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৯২-৯৩)।
বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে নিজের কর্মফলের সঠিক উত্তর প্রস্তুত করা, নিজের হিসাব নিজে কষা, সর্বদা গভীর দৃষ্টি রাখা : কী বলছে, কী করছে, কী নিচ্ছে ও দিচ্ছে ! যাদের বুঝের ক্ষমতা, চিন্তা ত্রার মেধা ও ঈমানি শ্রবণ ইন্দ্রিয় রয়েছে, তারা আল্লাহর সৃষ্ট মাখলুক থেকে উপদেশ হাসিল করে।
রাতে ঘুম ও দিনে। জীবিকা অর্জনের প্রতিযোগিতা আল্লাহর নিদর্শন, তাওহিদ ও কুদরতের দলিল। ইবাদত বা প্রয়ােজন ছাড়া যে রাত জাগল, সে মানব প্রকৃতির বিরােধিতা করল, আল্লাহ সুবহানা ওয়তায়ালা আমাদের ঈমানি শক্তি মজবুত করে দিন এবং যাবতীয় অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন। আমীন।