পূর্ব-দক্ষিণ দুপাশের দুটি রুমে থাকেন স্ত্রী ও সন্তান। পশ্চিম পাশে একটি ছোট খুপরি টিনসেডের ঘরে থাকেন এক সময়কার জনপ্রিয় প্রতিনিধি।
নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিছানাহীন একটি ভাঙা খাটে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে প্রায় ৫ বছর ধরে। অযত্ন-অবহেলায় আর বিনা চিকিৎসায় দিন দিন মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন তিনি।
শুয়ে থাকা খুপরি ঘরে নেই কোনো জানালা। উপরে অর্ধেক চাল থাকলেও বাকিটা খোলা আকাশের নীচে। এক বছর ধরে একটি পঁচা দুর্গন্ধ তোষক তার সঙ্গী। বিছানাহীন শুয়ে থাকায় শরীর অর্ধেক গেছে বাঁকা হয়ে। এক কাত হয়ে পড়ে থাকায় পিঠে গাঁ হয়ে গেছে। তার চুল, গোঁফ, হাতের নখ কোনোটাই কাটা হয়নি। মলমূত্র ত্যাগ করেন এখানেই। চারদিকে মশা-মাছির ভনভন শব্দ। দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। মানুষ দেখলে বিস্ময় করে তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে ভয়ে চোখ লুকিয়ে রাখেন। পেটে ক্ষুধা থাকলেও শুধু দূর থেকে মুখে পানি ঢেলে দেওয়া হয়। পেটে ক্ষুধা থাকায় খাবার দেখলেই মুখ হা করেন। এ সময় দূর থেকে মাঝে মাঝে মুখে খাবার তুলে দেন স্ত্রী ও সন্তানরা। পরিবারের সদস্যদের ধারণা বেশী খাবার দিলে মূলমত্র বেশী আসে তাই খাবার কম দেওয়া হচ্ছে।
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না নিজের স্ত্রী ও সন্তান এমন আচরণ করতে পারে। সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার রুপসী ইউনিয়নের ৮ নং সাবেক ইউপি সদস্য পল্লীচিকিৎসক আব্দুল বাকী খান (৬০) শেষ বয়সে জীবনে এসে এমন অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০০৩-১১ সাল পর্যন্ত তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি একজন স্বনামধন্য পল্লীচিকিৎসক। এইচএসসি পাস করে পল্লীচিকিৎসাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে নজরে এসে মানুষের। তাই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন ইউপি সদস্য। বিয়ে করেন নূরজাহান বেগম ঝর্ণাকে। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার ছিল।
হঠাৎ স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় ঘর সংসার ভেঙে যায়। ডিবোর্স দেন ঝর্ণাকে। স্ত্রী আদালতে মামলা দায়ের করলে দীর্ঘদিন পর একসাথে হন তারা। এরই মাঝে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন তিনি। ২০১৭ সাল থেকে এসব ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। মাঝে মাঝে চলাফেরা করতে পারলেও প্রায় এক বছর ধরে একই স্থানে পড়ে আছেন। স্ত্রী ও সন্তানও খোঁজ রাখেন না তার।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বড় ছেলে জাহিদ ঢাকায় থাকেন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া তিনি স্বামীর বাড়িতে। ছোট ছেলে ইবাদ ও তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে থাকেন। গতকাল স্ত্রী নূরজাহান বেগম ঝর্ণাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। বাড়ির লোকজন জানান, তিনি তিন ধরে আত্মীয়ের বাড়িতে। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসা যাওয়া হলেও বেশীর ভাগ সময় ঢাকা ও আত্মীয়ের বাড়িতেই থাকেন স্ত্রী ঝর্ণা।
শেষ বয়সে এমন জনপ্রিয় ব্যাক্তিটির দুরঅবস্থার কথা জানতে চাইলে ছোট ভাই সবুজ মিয়া জানান, ভাইকে আমরা ও এলাকাবাসী কোনো সেবা বা সাহায্য সহযোগিতা করতে পারি না। স্ত্রী ঝর্ণা বেগম খুবই বদমেজাজী। তার মুখের ভাষার কারণে ভাইকে একনজড় দেখতে যেতেও ভয় লাগে।
এলাকার বাদশা ও কাদির জানান, অসুস্থ এ জনপ্রতিনিধির সঙ্গে স্ত্রী ঝর্ণার পারিবারিক জীবনে সুসম্পর্ক না থাকায় এ সুযোগে স্বামীর সাথে এমন আচরণ।
আব্দুল বাকী খান তুলা মিয়ার ভাগিনা শফিকুল ইসলাম জানান, মামাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। এমন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধির দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারছি না। এ বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আমির উদ্দিন তালুকদার জানান, আমার সময়ে তিনি সবচাইতে সফল জনপ্রতিনিধি হিসাবে সুপরিচিত হন জনগণের কাছে। সবসময় মানুষের পাশে রয়েছেন। এমন দুরঅবস্থা শুনে খুব খারাপ লাগছে। বিনাচিকিৎসায় অযত্ন-অবহেলায় একজন জনপ্রতিনিধির মৃত্যু হতে পারে না।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ