Lead Newsআন্তর্জাতিককরোনাভাইরাস

যথেষ্ট গবেষণা ছাড়া রেমডেসিভিরকে কেন ‘কার্যকর’ বলছে যুক্তরাষ্ট্র?

সপ্তাহ দুয়েক আগে ওষুধ নির্মাতা গিলিড সায়েন্সের এক ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে- যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউটের (এনআইএইচ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় রেমডেসিভির নামের একটি ওষুধ প্রয়োগে সুফল পাওয়া গেছে।

এতে আড়াই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানির পর করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবিলার মোক্ষম অস্ত্র পাওয়া গেছে বলে আশা জেগেছে বিশ্ববাসীর মনে।

তবে এই আশার আলোর পেছনে রয়েছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জটিল অধ্যায়! নতুন কোনও ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেটি রোগীদের জন্য কতটুকু নিরাপদ ও কার্যকর তা নির্ধারণ অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। তার ওপর গবেষণা কোন পর্যায়ে সমাপ্তি টানতে হবে তা নিয়েও রয়েছে জটিলতা। সম্প্রতি হুট করেই রেমডেসিভির গবেষণার সমাপ্তি টেনে এটি করোনার চিকিৎসায় কার্যকর ঘোষণা করা নিয়েও চলছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা।

এ বিষয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট স্ট্যাটনিউজ ডটকম। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য এর চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (এনআইএআইডি) জন্য করোনা আক্রান্তদের রেমডেসিভির দেয়ার সিদ্ধান্তটা বেশ জটিল ছিল। যেসব রোগীকে প্ল্যাসেবো (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ওষুধ; যেমন- স্যালাইন) দেয়ার কথা, গবেষণার প্রয়োজনে তাদের কয়েকজনের শরীরে রেমডেসিভির প্রয়োগ করা হয়। এই ট্রায়ালে দেখা যায়, রেমডেসিভির প্রয়োগ করা রোগীদের আট শতাংশ মারা গেছেন। বিপরীতে প্ল্যাসেবো গ্রহীতাদের মধ্যে মৃত্যুহার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, রেমডেসিভির প্রয়োগে প্রাণরক্ষার ক্ষেত্রে বড় কোনও পরিবর্তন আসেনি।

তবে এ নিয়ে কোনও আফসোস নেই এনআইএআইডি কর্তাদের মনে। সংস্থাটির ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর এইচ ক্লিফোর্ড লেন বলেন, ‘এটাই ঠিক, এ বিষয়ে ইনস্টিটিউটের সবারই সম্মতি ছিল।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে থাকাকালীন ১১ দিনের মধ্যেই রেমডেসিভির গ্রহণকারী রোগীদের অক্সিজেন সহায়তা দেয়া বন্ধ হয়েছিল বা তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন, যা প্ল্যাসেবো গ্রহণকারীদের চেয়ে অন্তত চারদিন কম।’

তবে লেনের সঙ্গে একমত নন সেন্টার ফর হেলথ পলিসি অ্যান্ড আউটকামস অ্যাট মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারের পরিচালক পিটার ব্যাচ। তিনি বলেন, ‘আমরা গোটা সমাজ বন্ধ (লকডাউন) করে রেখেছি করোনা রোগীদের হাসপাতালে কাটানো সময় কয়েকদিন কমানোর জন্য নয়, রোগীদের মৃত্যু ঠেকাতে।’

রেমডেসিভিরের ফলাফল যখন ঘোষণা করা হয়, তখন এনআইএইচ বলেছিল, এই তথ্য এসেছে অভ্যন্তরীণ এক বিশ্লেষণ থেকে। অর্থাৎ, গবেষণাটি দ্রুতই শেষ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ, তারা এই ওষুধটির কার্যকারিতা সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত হয়েছিল যে, এ নিয়ে আর গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে এই সিদ্ধান্ত মোটেও সঠিক ছিল না বলে মনে করেন ক্লিফোর্ড লেন। তার মতে, গবেষণাটি স্বাভাবিকভাবে শেষ করে তবেই ফলাফল প্রকাশ করা উচিত ছিল।

রেমডেসিভির নিয়ে এসিটিটি (অ্যাডাপটিভ কোভিড-১৯ ট্রিটমেন্ট ট্রায়াল) গবেষণা শুরু হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। এর প্রথম ডোজ নেয়া রোগী ছিলেন ডায়মন্ড প্রিন্সেস প্রমোদতরী থেকে করোনায় আক্রান্ত এক মার্কিন নাগরিক। গবেষণার অংশ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের রেমডেসিভির বা প্ল্যাসেবো দেয়া হয়। ১৫ দিনের মাথায় এ গবেষণার ফল হতো, প্রতি আটজনে একজন, অর্থাৎ সুস্থ আটজনের বিপরীতে একজনের মৃত্যু।

তবে চীনেও রেমডেসিভির নিয়ে গবেষণার কথা শোনার পর লেন ও তার দল চিন্তা করেন, ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ওষুধটি উপকারী হলেও তাদের গবেষণার ফলাফল ব্যর্থ আসতে পারে। একারণে গত ২২ মার্চ গবেষণার ধরন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তারা। একদিনে আট পয়েন্ট স্কেলে রোগীদের অবস্থা পরিমাপের বদলে অধ্যয়ন করা হবে সেই সময়টা, যতক্ষণ পর্যন্ত রোগীরা নির্ধারিত তিনটি ফলাফলের একটিতে পৌঁছান। ২ এপ্রিল এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়; গত ১৬ এপ্রিল এটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সরকারি রেজিস্ট্রি ক্লিনিক্যালট্রায়াল ডট গভ-এ পোস্ট করা হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, গবেষণার ধরন পরিবর্তন না করলেও এর ফলাফল ইতিবাচকই আসত বলে মনে করেন এইচ লেন। যেহেতু গবেষণার ধরন বদলানো হয়েছে, তাই এটি বিশ্লেষণের ধরনও বদলাতে হচ্ছে। এখন এনআইএআইডি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিশ্লেষণ হবে সেই সময় থেকে যখন ১ হাজার ৬৩ জন রোগীর মধ্যে ৪০০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

এসব ফলাফল বিশ্লেষণ করে সাধারণত ডিএসএমবি (ডাটা অ্যান্ড সেফটি মনিটরিং বোর্ড) নামে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি। পরিচয় গোপন থাকলেও তারাই মেডিকেল গবেষণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাধর জোট। তাদের কাজ মূলত দু’টি: পরীক্ষামূলক ওষুধে রোগীদের কোনও ক্ষতি যেন না হয় তা নিশ্চিত করা এবং ওষুধটি সন্দেহাতীত ভাবে কার্যকর সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।

তবে ডিএসএমবি রেমডেসিভির গবেষণার কোনও বিশ্লেষণ করেনি বলে জানিয়েছেন ক্লিফোর্ড লেন। এ গবেষণায় ২০ এপ্রিলের মধ্যেই সব রোগীর তথ্য গুটিয়ে নেয়া হয়। ২২ এপ্রিল এ তথ্য নিয়ে ডিএসএমবির বৈঠকের কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়। ২৭ এপ্রিল এ কমিটি বৈঠক করে এবং ওই দিনই এনআইএআইডর কাছে তারা একটি সুপারিশ করে।

ওই সুপারিশে প্ল্যাসেবো গ্রহণকারী রোগীদের রেমডেসিভির দেয়া হবে কি না তার কোনও উল্লেখ ছিল না। বরং এতে ডিএসএমবি গবেষণার পরবর্তী ধাপের সুপারিশ করে যেখানে রেমডেসিভিরের বিপরীতে এলি লিলির তৈরি আর্থ্রাইটিসের ওষুধ ওলুমিয়ান্টের পরীক্ষা করতে বলা হয়।

এ সুপারিশের ভিত্তিতেই এনআইএআইডি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, প্ল্যাসেবো গ্রহণকারী সব রোগীকেই রেমডেসিভির দেয়া যাবে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে এ কার্যক্রম একপ্রকার শুরুও হয়ে গেছে।

তবে এখানে দ্বিতম পোষণ করেন লেন। তার মতে, মাত্র ১ হাজার ৬৩ জনের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে যাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৪৮০ জন। এ বিষয়ে গবেষকরা আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে অস্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে, গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল পুরোপুরি বিশ্লেষণের আগেই করোনার চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। আবার চীনের এক গবেষণাতে রেমডেসিভির অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ নিয়ে আরও কয়েকটি গবেষণার ফল শিগগিরই প্রকাশ হতে পারে। তখন এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + 20 =

Back to top button